বদলের কথা

অয়ন চট্টোপাধ্যায়

Posted On: June 4, 2021

বদলের কথা

অয়ন চট্টোপাধ্যায়

চারিদিকে বদলের যে হিড়িক পড়েছে, বিচিত্রপত্রও সেখানে ব্যতিক্রমী নয়। তার বদলটা অবশ্য বাকিগুলোর নিরিখে নেহাতই জলভাত। এতে নেই কোন টাকা-পয়সার লেনদেন, নেই ‘আমরা-ওরা’ কিংবা নেই বাপ-ঠাকুদ্দা তুলে খিস্তি-খেউড়। তার চাইতেও বেশী আনন্দদায়ক, অন্য বদলগুলোর ক্ষেত্রে যেখানে সুফলের চাইতে কুফল নিয়েই নিশ্চয়তা বেশি, সেখানে বিচিত্রপত্রের বদলটা যে ভালোর দিকেই, সে বিষয়ে তেমন সন্দেহের অবকাশ নেই পাঠকমহলে। অন্তত বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে তেমনটাই মনে হয়। এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। সেগুলোকেও বদলের পথে পাথেয় করেই এগিয়ে চলেছে বিচিত্রপত্র। সে বদলাচ্ছে তার রূপে, গুণে এবং বৈচিত্রে। আর পাঠকেরা যে সেই বদলকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন ক্রমাগত, তা-ই আমাদের পরম প্রাপ্তি। ক্রমপরিবর্তনের অঙ্গ হিসেবেই এই সংখ্যা থেকে সম্পাদনার দায়িত্বে বাকি দুজনের সঙ্গে ঝুলে পড়লাম আমিও। সঙ্গে যুক্ত হল আরেকটা সম্পাদকীয় বিভাগ, ‘অবশেষে’। নামটা অবশ্য সৌরদীপদার (বিচিত্রপত্র-র বড় সম্পাদক সৌরদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়) মস্তিষ্কপ্রসূত।

বদল— সামান্য একটা তিন অক্ষরের শব্দ। তবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ। আবার অনেক ক্ষেত্রে একঘেয়েও। কারণ প্রায় প্রতি বছরই শোনা যায় এর কথা, কিন্তু চোখে দেখা যায়না। মাঝেমধ্যে দেখা গেলেও সেগুলো এমন এমন বদল যা হয়ত না ঘটলেই খুশি হত সাধারণ মানুষ। তাই এই একঘেয়ে শব্দটা এখন পরিণত হয়েছে আমাদের হাসি-ঠাট্টা-মস্করায়। তাতেও বিশেষ আপত্তি নেই। কিন্তু মুশকিলটা হল এই যে, সাধারণ মানুষ এখন একঘেয়ে বিষয়টার একঘেয়েমি কাটাতে নিজেরাই এতটা মশগুল হয়ে গিয়েছেন সেই সার্কাসে যে, প্রধান ইস্যুগুলোই আর কারোর ভাবনার চৌহদ্দিতে নেই। গোটা ব্যাপারটাই যেন পরিণত হয়েছে স্রেফ একটা তামাশায়। মানুষ আর ভাবতে চাইছে না তাদের সমস্যাগুলোকে। অথবা অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে ভাবতে দেওয়া হচ্ছে না তাদের। সিনেমা, সাহিত্য, সংগীত, খেলাধূলা, যাত্রাপালা এগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যেমন কেবলমাত্র বিনোদন হয়ে ধরা দেয় দর্শকের কাছে, ঠিক তেমনই রাজনীতিটাও রূপান্তরিত হয়েছে একটা বিনোদনে। সেখানে সামাজিকতার দিকটা আজ লুপ্তপ্রায়। এইতো সেদিন এক নেতা টেলিভিশনে সদর্পে বলে গেলেন, “ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করার কথা তো ঘরের ভেতরে। জনসভায় সেসব পাবলিক খায় না।” সত্যিই তো। পরনিন্দা পরচর্চার মতো ‘পাবলিক খাওয়ানো’ বিষয় তো আর কিছু হয়ও না।তাতে টিআরপি-ও বাড়ে তরতরিয়ে। ঘরের ভেতরে সমাজ, রাজনীতি, ইস্যু-টিস্যু নিয়ে আলোচনা তো বোদ্ধাদের কাজ! সাধারণ মানুষের গামছায় ঘামের গন্ধই মানানসই, অভিজাত টিস্যুর সুগন্ধি কি আর সেখানে সাজে? তাই পাবলিক ফোরামে ‘ইস্যু’নামক শৌখিনতা বাদ দেওয়াই শ্রেয়। পাবলিক বরং পাবজি খেলতে খেলতে বোতামটা টিপে দিলেই হল। স্টারদের যেমন মাঝেমধ্যে দেখা যায় রূপোলী পর্দায় কিংবা মঞ্চে, ঠিক তেমনই এইসব নেতা-নেত্রীদের দেখা যায় পাঁচ বছর অন্তর রাজনীতির ‘রঙ্গমঞ্চে’। পার্থক্য বলতে, স্টারেরা থাকেন বেশ রঙচঙে মেক-আপ টেক-আপ নিয়ে আর এঁরা থাকেন একগাদা মিথ্যে প্রতিশ্রুতির মেক-আপ নিয়ে।

যে দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনও প্রকৃত শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, সুবিধাবাদীরা যে সেই সুযোগে নিজেদের আখের গোছাবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, তাদের এই আখের গোছানোর বিষয়টি সম্পর্কে আজ সমাজের প্রায় সমস্ত শ্রেণীর মানুষই কমবেশি অবগত আছেন। আরে দাদা,ওখানে বদল হোক বা বদলা — আমাদের জীবনে কিসসু বদলাবে না। ওরা ঠান্ডা ঘরে বসে সব বেচেবুচে নিজেদের সম্পত্তি বাড়াবে আর আমরা বাস, ট্রেনে ভিড়ে গাদাগাদি করে ঘামের গন্ধ শুঁকেই দিন কাটাবো। বড়জোর এসব মিটলে আবার আমি-আপনি চায়ের কাপে তুফান তুলব। আর আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসবেন চা বানানেওয়ালা। অর্থাৎ জেনেশুনে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়াই এখন আমার-আপনার মজ্জাগত। কারণ, আওয়াজ ওঠানোর মতো মেরুদন্ডীর বড়ো অভাব যে আজকের সমাজে। সাধারণ মানুষ তার চাইতে সুপিরিয়র অথচ তার মতোই রোদ-বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে সরকারের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সেই প্রতিনিধিকে আর খুঁজে পাচ্ছে না। আর সেই অমেরুদণ্ডীতার সুযোগ নিয়ে প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই ঢুকে পড়েছে ধ্বজাধারী, বিভিন্ন রঙের রাজনীতি এবং পক্ষপাতিত্বের বিষ। কিন্তু এইসবের চাইতেও দুঃখের বিষয় হল, সামনের সারিতে থেকে পিছিয়ে পড়া অসহায়ের বুকে প্রতিবাদের বোধ, নিজেদের অধিকারবোধ এবং সম্মানবোধ জাগিয়ে তোলার কথা ছিল যাদের, সেই তথাকথিত শিক্ষিত, সুশীল, সংস্কৃতিবান ‘এলিট’ সমাজও আজ বেমালুম মুখ বুজে থাকাকে তাদের ‘এলিটিজম’-এর অঙ্গ বলেই মনে করে নিয়েছেন। ‘নো কমেন্টস’ এখন ‘এলিটিজম’-এরই স্বরূপ। অন্যায়ের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাই এদের পরোক্ষ দায়িত্ব যে থেকেই যায়, সেটা বোধ হয় এই শিক্ষিত চোখগুলো এড়িয়ে যাচ্ছে জেনেশুনেও। অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা মানেই যে রাজনৈতিক কচকচানি নয় — এই মৌলিক চিন্তাধারাটাই লুপ্তপ্রায় তাদের মগজ থেকে। ‌কিন্তু কেন? নিরপেক্ষ মঞ্চ বলে একটা মঞ্চ কিন্তু এখনও টিমটিম করে হলেও জ্বলছে, সেটা ভুলে গেলে চলবে না। সেখানে নেই কোন লাভ-ক্ষতির খতিয়ান, নেই ‘আমরা-ওরা’, নেই খিস্তি-খেউড়। রয়েছে একটা সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল, রুচিবোধ, শালীনতা এবং সত্যিকরের বদলের কথা। বিভিন্ন সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার সেই মঞ্চটাই হয়ত নিরপেক্ষতা আমাদের দেয়। তাকে হাতিয়ার করার দায়িত্বটাও বর্তায় মূলতঃ ‘এলিট’ সমাজের ওপরে। তবে দায়িত্ব নিলেই যে তক্ষুণি বদলটা দেখা যাবে, এমন নয়। ‘এক্সপেক্টেশন জিরো’ নিয়েই নামতে হয় এই মঞ্চে। আর সেখানেই বোধ হয় আপত্তি বেশিরভাগের — আরে মশাই, একটা কুইক আউটকাম না থাকলে কি আর পোষায় বলুন তো! সত্যিই তো, টেস্ট ম্যাচ আর ক’জনই বা দেখেন? টি-টোয়েন্টিতেই যে আসল বিনোদন।

যাগ্গে, গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে কথা হয়ে গেল খানিক। বেশ ভালোই তো ছিল রে বাপু পত্রিকার কন্টেন্ট, কি দরকার ছিল খামোখা এইসব উটকো জ্বালাতনের! দরকার হয়ত ছিল না, পত্রিকার মেজাজটাকে এইভাবে ভঙ্গ করার। কিন্তু, যাঁকে নিয়ে বিচিত্রপত্র-র এই সংখ্যা, সেই মানুষটিও কিন্তু আজীবন নিরপেক্ষতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে চূড়ান্ত প্রতিবাদ করে গিয়েছেন তাঁর কাজের মাধ্যমে। বিশ্বজনীন ভাবে। কখনও তা ‘গণশত্রু’ কিংবা ‘হীরক রাজার দেশে’-তে, আবার কখনও ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর মধ্যে দিয়ে। আবার মগনলাল মেঘরাজকেও তাঁর প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পিছপা হননি অনেক সময়েই। সুতরাং, বর্তমানে রাজ্য তথা দেশের যে উদ্ভট পরিস্থিতি, সেখানে সত্যজিৎ রায়ের শতবর্ষে দাঁড়িয়ে কেবল ‘আহা আহা’ করে হুজুগে মাতার চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিকতার আঙ্গিকে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করার। এবং তাঁর ভাবনাচিন্তা, আদর্শকে শুধুমাত্র কলার তোলার উদ্দেশ্যে ইন্টেলেকচুয়ালিজম বা এলিটিজমের খাতে ব্যবহার না করে নিজেদের সার্বিক ভাবনাচিন্তার বদলে ব্যবহার করার। আর সকলের মধ্যে সেই শিক্ষা এবং সামাজিকবোধের বীজ বপন করার। তাহলেই হয়ত উদয়ন পন্ডিতের স্বপ্ন সার্থকতা লাভ করবে। তাহলেই হয়ত সত্যি একদিন অত্যাচারী রাজার দর্পচূর্ণ হয়ে মিশে যাবে পদতলে। আর তাহলেই হয়ত শতবর্ষে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের বৃত্তটা সম্পূর্ণ হবে প্রকৃত অর্থে।

নমস্কারান্তে,