গোড়ার কথা

সৌম্যকান্তি দত্ত

Posted On: June 5, 2021

কথা হচ্ছে, ‘বিচিত্রপত্র’ নিয়ে কিছু বলবার সময় এসেছে। আসলে হয় কি, প্রতিবার বিচিত্রপত্র ছাপতে যাবার ঠিক মুখে আমার গোড়ার কথা লেখা শেষ হয়। তার আগে মোটে সময় পাই না। কাজেই বলার বিষয়গুলো না-বলাই থেকে যায়। এবারেও তার ব্যাতিক্রম কিছু হয়নি। কিন্তু, এবার বলতেই হয়। বিগত চার বছর ধরে সংস্কৃতিমনষ্ক বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছেছে বিচিত্রপত্র। কিন্তু, কীভাবে পৌঁছেছে তা আমরাই টের পেয়েছি হাড়ে হাড়ে। আজকের বাজারে, বড় কোনও অর্থনৈতিক সহযোগিতা ছাড়া পত্রিকা বার করা বেজায় মুশকিল। কদ্দিনই-বা আর গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে কাগজ বার করা যায়? কিন্তু, বিচিত্রপত্র-র পরিচালন সমিতির সদস্যদের সাহস বুঝি কম নয়। বুকের দমও ষোলোয়ানা। কাজেই তাঁরা যেন একরকম উত্তর গোলার্ধ আর দক্ষিণ গোলার্ধকে এক করে আঁটঘাট বেঁধে নেমেছেন ‘বিচিত্রপত্র’-কে বাঁচিয়ে রাখবেন বলে। শেষ এখানেই নয়— এই সত্যজিৎ শতবর্ষ সংখ্যার জন্য পরিচালন সমিতির প্রত্যেক সদস্য দিন-রাত এক করে অর্থ জোগাড় করেছেন, মাঝেমধ্যে নিজেদের ‘কাবুলিওয়ালা’-র সঙ্গে তুলনা করতেও ছাড়েননি। এই তো, একজন বললে—‘নিজেকে সত্যিই কাবুলিওয়ালা কাবুলিওয়ালা ফিল্‌ করছি। ব্যাপারটা বেশ অন্যরকম কিন্তু যাই বলো তাই বলো।’ লোকেদের আমাদের ‘বিচিত্রপত্র’-র কাছে অনেক প্রত্যাশা। ভালো কাগজ চাই, আরও উন্নত ছাপা চাই, রঙীন পৃষ্ঠা হলে মন্দ হয় না, কখনো-বা নাক কুঁচকে কেউ ফোঁস করে বলেই বসলেন—‘মশাই, আপনাদের তো কোনও সময়জ্ঞানই নেই। আজ বলে পরশু কাগজ বের করেন, বছরে চারটে সংখ্যা বলে তিনটে প্রকাশ করেন­— বলি আপনাদের কি কথার কোনও দাম নেই?’ সত্যিই লজ্জ্বার! কিন্তু, এই বাজারে একজন গৌরী সেন দূরে থাক— তাঁর বাড়ির ঠিকানাটা অন্তত আমাদের বাতলে দিন, আমরা যোগাযোগ করে নেব তাঁর সঙ্গে, কথায়-কথায় হাজার হাজার টাকা লিখে দেবার জন্য। আমাদের প্রেসের লোকেরাও ভারী দয়ালু। তাঁরা দিনের-পর-দিন হাজার-হাজার টাকা ধার রেখে আমাদের কাগজ ছেপে দিয়েছেন। এক-একটা সংখ্যা কোনও ক্রমে বার হয় আর আমাদের লোকেরা হাত কচলাতে কচলাতে বলেন—‘নাহ্‌, এবার একটা-না-একটা হিল্লে করতেই হবে! এভাবে আর কদ্দিন!’ কিন্তু, সে হিল্লে দিল্লি দূরের মতো ব্যাপার। পত্রিকার উপদেষ্টা থেকে শুরু করে সম্পাদক, প্রকাশক, নির্বাহী সম্পাদক, সম্পাদকমণ্ডলী ও পরিচালকমণ্ডলীর সকল সদস্যদের চিন্তার শেষ নেই। কিন্তু, পাঠক— আপনাদের মুখ চেয়েই, আপনাদের প্রত্যাশা সাধ্য মতো পূরণ করবার তাগিদেই তো এতও ঝক্কি পোহানো।

এবার একটা ভালো খবর দিই? এই সেদিন আমাদের মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হল সৌরদীপদা ও আমার সঙ্গে এবার অয়ন ‘বিচিত্রপত্র’-র সম্পাদনায় দায়িত্বে আসবে। তাতে ওর আহ্লাদ দেখে কে? অয়ন অ্যাদ্দিন সহ-সম্পাদনার দায়িত্ব সামলেছে, সম্রাটের সঙ্গে। কিন্তু এবার অয়ন জায়গা ফাঁকা করে দিল সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দেবাশিস সেনকে। দেবাশিসকাকু আর সম্রাট নির্বাহী সম্পাদক। কিন্তু, এই দু’জনকে ক’দিন এক আসনে ভাগাভাগি করে ধরে রাখা যাবে— সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, দু’জনের মধ্যে প্রথমজন ইস্টবেঙ্গল আর দ্বিতীয়জন মোহনবাগানের মারকাটুরে সমর্থক। মোট কথা, সেদিন বিচিত্রপত্র-র প্রকাশক ও উপদেষ্টা খুব দুঃখ করে বললেন—‘সবারই তো পদোন্নতি পদস্খলন দেখছি। কিন্তু আমরা তো তার মাঝামাঝি জায়গায় পড়ে রইলুম! উঠতেও পারলাম কই, নামতেও পারলাম কই?’ বুঝুন— এর পর আর বলার কী আছে?

এবারের ‘বিচিত্রপত্র’ সব দিক থেকেই বৈচিত্র্যপূর্ণ— একথা বলাই বাহুল্য। সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যু পরবর্তীকালে কোনও পত্রিকার একই সংখ্যায় ওঁর এতগুলো অপ্রকাশিত লেখা, অগ্রন্থিত লেখা, দুর্লভ সাক্ষাৎকার, অপ্রকাশিত চিঠি, গান, আঁকা ছবি ছাপা হয়েছিল বলে তো অন্তত আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। কী, পাঠক— আপনার কী মনে হচ্ছে? ডোজ বেশী হয়ে গেল নাকি! তা হবে নাই-বা কেন, অ্যাঁ? যাঁর সৃষ্ট নাম থেকে ‘বিচিত্রপত্র’ পত্রিকার নামকরণ, যাঁর আদর্শকে পাথেয় করে ‘বিচিত্রপত্র’-র পথ চলা, যাঁর কোন-না-কোন সৃষ্টিকে সঙ্গে নিয়ে ‘বিচিত্রপত্র’-র প্রতিটা সংখ্যা হয়ে ওঠে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ— তাঁর যখন একশো বছর পূর্তি বলে কথা, তখন এটুকু হবে না? পরিকল্পনা তো ছিল কত! ‘বিচিত্রপত্র’-র আয়োজনে বিরাট অনুষ্ঠান করে ওঁর জন্মদিন উদযাপন করা হবে— প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হবে! কিন্তু সে সব আর হল কই? কোত্থেকে একটা বিদঘুটে ভাইরাস এসে সবেতেই একেবারে জল ঢেলে দিল। তার উপর তো, ভোটাভুটি আছেই। দুঃখের বিষয়, এ-দেশের বর্তমান রাজনীতিতে একটা রাজনৈতিন দলও নেই যাদেরকে পুরোপুরি না হোক, এই অ্যাতটুকুও ভরসা করা যায়! একটি সর্বভারতীয় দল ও একটি আঞ্চলিক দলের কথা তো ছেড়েই দিলাম— তাঁদের কোনও মনুষ্বত্বই নেই। তাঁদের সম্পর্কে কথা বলা মানে কেবল সময় নষ্ট। কিন্তু, তথাকথিত যে দু’টো দলের আদর্শ ছিল, শিক্ষা ছিল, সংস্কৃতি ছিল— তাঁরাও আজ ক্ষমতার লোভে নিজেদের বিকিয়ে দিচ্ছেন। ভাবতে কষ্ট হয়, একসময় যে পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে প্রতিবাদের ভাষা ছিল গণনাট্য সঙ্গীত— আজ সেখানে একের-পর-এক রুচিবিহীন সঙ্গীতকে প্যারোডি বানিয়ে তাগ-ধিনা-ধিন-ধা করা হচ্ছে! অনেকে আবার বলছেন, সমস্ত শ্রেণীর মানুষের মাঝে পৌঁছতে এখন এই মাধ্যমই প্রয়োজন। নয় তো আঁতেল শ্রেণীর অন্তর্গত হয়েই থাকতে হবে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সবারই ব্যাক্তিগত মতামত আছে। তাই আমিও আমার মতটাকেই বললাম। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সেটা আমি কারোর ওপর জোর করে চাপিয়ে দিলাম। জোর করে চাপানোর তো আমি কেউ নই! কিন্তু এখন সেটাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে— কাজেই গণতন্ত্রের নামে প্রহসন চলছে। পশ্চিমবাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শ্রীবুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি, তাঁর সততাকে সম্মান করি। কিন্তু তাই বলে, বর্তমানে সেই অসুস্থ মানুষটার নাম, বক্তব্য ব্যবহার করে আমি ভোট আদায় করতে পারিনা। এখানে আমার মেরুদণ্ড বলে তো কিছুই থাকল না। কথায় বলে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম না বোঝা। ব্যাপারটা তো তাই। আজ মানুষটা শারীরিক দুরাবস্থার কারণে রাজনীতি থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি এখন আর ‘Available’ নন। তাই তাঁকে নিয়ে এখন এতও মাতামাতি। তাঁর দলের লোকেরা বলছেন—‘ওঁর মতো মানুষ হয় না। ওঁর মতো এই হয় না, সেই হয় না!’ আহাম্মকের দল এটুকু বোঝে না— অসুস্থ, অসহায় মানুষটাকে নিয়ে ক্রমাগত নাড়াচাড়া করে নিজেরা নিজেদের দুর্বলতাকে আরও জনসমক্ষে টেনে আনছেন! মানে, দেখো— আমরা তো আর কেউ সৎ, মহান, প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত নই— ওই একজনই আমাদের মধ্যে আছেন, তাই ক্ষমতার লোভে তাঁকে নিয়ে এখন এতও মাতামাতি। এতগুলো কথা বলতাম না, কিন্তু বললাম কোথাও একটা দুর্বলতা কাজ করে তাঁদের প্রতি তাই। মানুষ তো নিজের ঘরের লোককেই স্নেহ করে, প্রশ্রয় দেয় আবার ভুল করলেও বকে-মেরে, বুঝিয়েও দেয়। তাই আর কী!

আজ নয়-নয় করে অনেক কথাই বললাম। কিন্তু, বলার বুঝি শেষ নেই। এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে ইন্দ্রাণীদির মুখটা। ইন্দ্রাণীদি মানে ‘মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড’-এর অন্যতম কর্ণধার ইন্দ্রাণী রায়— কলেজ স্ট্রীট পাড়ার প্রবাদপ্রতিম প্রকাশক সবিতেন্দ্রনাথ রায়, ওরফে ভানুবাবুর বড়মেয়ে। কিছু কিছু মৃত্যু আসে, যা মেনে নেওয়া বেজায় কঠিন। ঠিক তেমনই, বড় অসময়ে চলে গেলেন ইন্দ্রাণীদি। আমার সঙ্গে ওঁর শেষ দেখা ‘মিত্র ও ঘোষের’ আপিসে— জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। আসলে শংকরদা, অর্থাৎ শংকরলাল ভট্টাচার্যর রবিশঙ্করকে নিয়ে বেশ কিছু লেখার একটা সংকলনের সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমায় ইন্দ্রাণীদি। সেদিনটা আমার এখনও মনে পড়ে। নভেম্বর মাসের বাইশ-তেইশ তারিখ। সৌমিত্রবাবু সদ্য চলে গিয়েছেন। ওঁর স্মৃতিতে দুরদর্শনের জন্য শংকরদার একটা সাক্ষাৎকার নিচ্ছি— তার শুটিং চলছে। হঠাৎই ইন্দ্রাণীদি আমায় ফোন করে বললেন— ‘সৌম্য, শংকরদার এই বইটার সম্পাদনার দায়িত্ব তোমায় নিতে হবে। বিভূতিভূষণ দিলে না যখন, অন্তত এই কাজটা তোমাকে করতেই হবে!’ আসলে, লকডাউনের একদম শেষের দিকে ‘বিভূতিভূষণ’ নামে একটি জীবনভিত্তিক উপন্যাস লেখার চেষ্টা করি আর সেটা ‘লালমাটি’ প্রকাশন বলে আমরা বই করব। এদিকে ইন্দ্রাণীদি বিষয়টা জানতে পেরেই আমাকে ফোন করে একদিন ধমক—‘এটা কেমন হল? আমরা বিভূতিভূষণের আদি প্রকাশক। তুমি আমাদের না দিয়ে অন্য প্রকাশনাকে দিয়ে দিলে?’ আমি অবাকস্বরে বললাম—‘আমার লেখা মিত্র ও ঘোষের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনা বই আকারে ছাপবে— এটা কল্পনাই করিনি। কাজেই অতটা সাহস কুলোয়নি।’ ইন্দ্রাণীদি বললেন— ‘আরে একবার তো বলবে। শোনো, যা হয়ে গেছে তা নিয়ে তো আর ভাবলে চলবে না। এবার থেকে নতুন কিছু লিখলে আগে আমাকেও জানাবে। আমি তোমাদের সঙ্গে সবসময় আছি।’

সেটা আর হল কই! ইন্দ্রাণীদির শরীরে মারণরোগের বাসা বাঁধার খবর পেয়েছিলাম আগেই। কিন্তু, গত ১৮ মার্চ, সকালে ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ফোনে খবরটা পেতেই কিছুক্ষণ থম্‌ মেরে গিয়েছিলাম! এতও তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা ঘটবে— ভাবিনি। ইন্দ্রাণীদির হতভাগ্য বাবা ভানুবাবু তাঁর ‘কথাসাহিত্য’ পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখেন ‘পথে ও পথের প্রান্তে’ নামে। তাঁর জীবনের সন্ধ্যাকালে জীবনের পথে ও পথের প্রান্তে যে এমন ভয়ঙ্কর শোক অপেক্ষা করছিল— তা আর কে জানত!