দুই বুড়োর ঘোরাঘুরি

রাহুল মজুমদার

Posted On: June 18, 2021

ভুখ হড়তাল রুটের বাস যখন দুই বুড়োকে জোশীমঠে এনে নামালো, বিকেল তখন বিদায় নেবার তাল করছে। চটপট একটা হোটেলের দোতলার ঘরে স্যাক নামিয়ে ঝটপট নেমে এলো টা সহযোগে চা চাখতে। চা খেতে খেতেই ঠিক হলো, অনেক হয়েছে হাঁটাহাটি, এবার দু দিন পুরো টুরিস্ট মোডে ঘোরাঘুরি। 

নভেম্বর মাস; সূর্য পাহাড়ের আড়ালে যাওয়ামাত্রই দাঁত শানিয়ে ঠান্ডা নেমে পড়ল ময়দানে। সাতটা অবধি লেপ মুড়ি দিয়ে গপ্পো মেরে রাত সাতটায় খেতে নেমে দু’জনের চক্ষু চড়কগাছ! গোটা গাড়োয়াল নিরামিষ বলেই জানা ছিল; কিন্তু টেবিলে টেবিলে বিয়ার আর তন্দুরি চিকেনের আসর! নিজেদের রুটি সবজি ডিমের ঝোল গিলে দু’জন মূর্তিমান বিস্ময়বোধক চিহ্ন হয়ে লেপ মুড়ি দিল।

পরদিন সকালে বার তিনেক চায়ের ডোজে ঠান্ডাকে ডান্ডা মেরে একপ্রস্থ বাজারে টহলদারি সেরে আলুর পরোটা আর জঘন্য কফির ব্রেকফাস্ট সারল। গন্ডোলা এগারোটার আগে চালু হবে না। ধীরে সুস্থে রোদ মেখে টুক টুক করে দুই বুড়ো সাড়ে দশটায় হাজির হলো গন্ডোলা-স্টেশনে। গড়সন টপ পর্যন্ত প্রায় সোয়া চার কিলোমিটারের যে কেবল কার চলে, তারই আদরের নাম গন্ডোলা। টিকিট কাউন্টার খুলতেই অন্য টুরিস্টদের সঙ্গে টিকিট (৬০০×২ টাকা) কেটে একপ্রস্থ চায়ে চাঙ্গা হয়ে নিল দু’জনে। লাইন দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গন্ডোলায় বসতেই চুপিসাড়ে উত্তেজনা এসে গেড়ে বসল। কেবল কারে এত লম্বা পথ এর আগে পাড়ি দেয়নি ওরা। একশো আশি ডিগ্রিরও বেশি তুষারশৃঙ্গের দর্শন এই যাত্রার মূল আকর্ষণ।

গন্ডোলা ছাড়তেই হু হু করে জোশীমঠ নিচের দিকে পালাতে লাগল। হাথী ঘোড়ী আগে থেকেই দেখা যাচ্ছিল, একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় ওঠার পর বাকিরাও দেখা দিতে থাকল। ‘উউউহ্’ ‘আআআআহ্’ ‘ঈঈঈঈঈস্’ নানারকম শব্দ গন্ডোলাময় পাক খেতে লাগল। 

একের পর এক টাওয়ার পেরোচ্ছে— নিচের ঢালু মেটে জমিটা শীতে পুরু বরফে ঢেকে যায়; তখন এই আউলিতে স্কীইংয়ের আসর বসে। বেশ কিছু খেলনার কটেজ, একটা কৃত্রিম (জলহীন) জলাশয় নিয়ে এখন নিচের ছবি। এর মানে আট নম্বর টাওয়ার পেরোচ্ছে গন্ডোলা। দশ নম্বর টাওয়ারে এসে আমাদের উগরে দিল গন্ডোলা। ২৯০৯ মিটারে এই প্রায় দুপুরেও দিব্যি ঠান্ডা। সামনের ফাঁকা চত্বরে প্রচুর টেবিল চেয়ার পাতা। ‘গরম কফি আর স্ন্যাকস সহযোগে’ সামনের প্রকৃতির অনন্যসাধারণ গ্যালারি দেখার জন্য। নন্দাদেবী ত্রিশূল থেকে কামেট হাথী ঘোড়ী সমেত অসংখ্য তুষারমৌলীর প্রদর্শনী। কাকে ছেড়ে কাকে কতক্ষণ দেখি! এ যে হাজারবার দেখেও তৃপ্তি হয় না!

গন্ডোলার আসা যাওয়া চলছে। মন চাইছে আমাদের নির্দিষ্ট গন্ডোলা যেন দেরি করে আসে। কিন্তু হায়, জীবনের সব সাধ কি পূরণ হয়? বাধ্য হয়েই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেরার গন্ডোলায় চড়তেই হলো।  নেমে এসে মনের দুঃখে দুই বুড়ো একটু বেশিই খেয়ে ফেলল। বাকি দিন আর রাতটা সেই দেবদুর্লভ গ্যালারির ছবি চোখে নিয়েই কেটে গেল।

ফোটো: লেখকের সৌজন্যে

Tagged with: