থ্রি মাস্কেটিয়ার্স

সৌরদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted On: June 15, 2021

।।১।।

ভালো গল্প লিখতে হলে তার শুরু আর শেষটা ভালো হওয়া দরকার; কেননা শুরুটা ভালো না হলে পাঠকেরা শেষ পর্যন্ত পড়ার উৎসাহ পান না আর শেষটা ভালো না হলে গল্পটা পাঠকের মনে জায়গা করে নিতে পারে না। কিন্তু কিছু গল্প আমরা কয়েকজন মানুষদের জীবন থেকে কুড়িয়ে পাই, সেই সব গল্প কি এতো নিয়ম মেনে লেখা সম্ভব! না, সম্ভব নয়। কেননা সেই গল্প লেখার ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের থেকে হৃদয়ের ব্যবহারই বেশি। আর আমি এখন যে গল্পটা বলতে চলেছি সে তো তিনজন বন্ধুর হৃদয়ের নানান টানাপোড়েন নিয়েই; তাদের একে ওপরের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে, অভিমান নিয়ে।

    সন্দীপ, অনুপম আর সুনীল— বইপাড়ায় সবাই এদের চেনে ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ নামেই, থুড়ি চিনত। একসাথে পত্রিকা সম্পাদনা থেকে শুরু করে বই প্রকাশ, তথ্যচিত্র নির্মাণ, লেখালিখি, সিনেমা দেখা, ঘুরতে যাওয়া সবেতেই ছিল তিনজন সমান পরিমাণে উৎসাহী। তবে কিছু ক্ষেত্রে তিনজনের মধ্যে তারতম্যও ছিল। যেমন, সন্দীপের ইচ্ছে বড় হয়ে চিত্র-পরিচালক হওয়ার, তাই ওর লেখনীর মধ্যে একটা সিনেম্যাটিক ছাপ ছিল। লেখা বলতে টুকটাক গল্প, মূলত প্রবন্ধ। অনুপমের ন্যাক আবার গান-বাজনা আর আঁকাআঁকির দিকে, বড়ো হয়ে সে সঙ্গীত পরিচালক হবে নাকি চিত্রশিল্পী— তা নিয়ে বেজায় বিভ্রান্ত সে; লেখার হাতও বেশ ভালো, ছোটদের জন্যই লিখতে পছন্দ করে। আর রইল বাকি সুনীল, সে বয়সে সন্দীপ আর অনুপমের থেকে কিছুটা বড় হলেও সম্পর্কটা একদম বন্ধুর মতোই, ওর অবিশ্যি নেশা/শখ/লক্ষ্য যাই বলি না কেন সব একটাই, লেখক হওয়া; নানান ছোটদের আর বড়দের পত্রিকায় ওর লেখাও বেরিয়েছে। এই সামান্য ভিন্নতা বাদ দিলে রুচিগত দিক থেকে এবং মানসিকতায় ওরা তিনজন ছিল অভিন্ন, সেই কারণেই একের পর এক নানারকম সৃষ্টিমূলক কাজ সুষ্ঠু আর সফলভাবে করে যেতে পারত। তবে এই কাজের পরিধির বাইরেও ওদের মধ্যে ছিল এক ভীষণ ভালোবাসার বন্ধন, বন্ধুত্ব। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও যে একে ওপরের প্রতি আত্মীয়তা গড়ে ওঠা সম্ভব, তার অন্যতম একটি নিদর্শন ছিল এই ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’।

    আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন আমি এতক্ষণ ধরে পাস্ট টেন্সে কথা বলছি কেন! কেননা এর পিছনে একটি অজানা কারণ রয়েছে। সময় সবকিছুকেই পাল্টে দিতে পারে, কিন্তু কোনো সম্পর্কের ভিত যদি শক্ত হয়, তাহলে সেটা পাল্টায় না। আর সম্পর্কের ভিত হল বিশ্বাস, যা একটু নড়বড় করলেই সব শেষ। সুনীল আর সন্দীপের মধ্যে কোনো একটা কারণে ঝগড়া হয়, সেই কারণটা কেউ জানে না— এমনকি অনুপমও নয়। সেই ঝগড়ার এক ভীষণ প্রভাব পড়ে ওদের সবার ওপরেই; ভেঙে যায় থ্রি মাস্কেটিয়ার্স, সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে যায় ওরা তিনজন। সে ঘটনার দু’বছর কেটে গেছে, ওরা আর একে ওপরের সাথে যোগাযোগ করেনি। সন্দীপ আর অনুপম নিজ নিজ কাজে কলেজস্ট্রিট অথবা রবীন্দ্রসদন যায়, তখন ওদের একে ওপরের সঙ্গে চোখাচোখি হলেও কথা হয় না; আর সুনীলের খবর কেউ জানেনা, ওর কোথাও লেখাও বেরোয়নি এই দু’বছরে।

।।২।।

“তোমরা আবার বোনের সাথে ঝামেলা করলে! কতবার করে বললাম না, এক বিষয় নিয়ে আর বলো না কিছু ওকে।”
“কি করি বল, এখানে এসেও সারাদিন ধরে ঐ ছেলেটার সাথে কথা বলে যাচ্ছিল। এমনি এমনি কি আর আমরা ওকে বকি! কি গো তুমি কিছু বলো না।”
“আমি তো রেগে ভেঙেই দিয়েছি ওর ফোনটা। যত নষ্টের গোড়া ঐ মোবাইল।”

    এই বাকবিতন্ডা চলছে অনুপমের সঙ্গে ওর মা-বাবার, প্রসঙ্গ ওর বোন অনুপমা। সে সদ্য ক্লাস ইলেভেনে উঠেছে এবং আহিরীটোলার এক ছেলের প্রেমে পড়েছে। এই প্রেম নিয়েই বাবা-মায়ের তীব্র আপত্তি, ওদের ধারণা ওদের ছেলেটা মোটামুটি মানুষ হলেও মেয়েটা একদম বখে যাচ্ছে।

    মাসখানেক হল অনুপম এখন শিলিগুড়িতে আছে, একটা পার্টটাইম চাকরী করছে। আর ওদিকে বাবা-মায়ের বারণ সত্ত্বেও অনুপমার প্রেম দিন-দিন বাড়তে থাকে; তাই হাওয়া বদলের মাধ্যমে যাতে মেয়ের মন পাল্টানো যায় তাই বাবা-মা ওকে নিয়ে আসে শিলিগুড়ি। কিন্তু এখানে এসেও রেহাই নেই, দাদার কাছে আবদার করে একটা ফোন হাতায় আর শুরু করে দেয় প্রেমিকের সাথে কথাবার্তা। কটাদিন ব্যাপারটা দেখার পর আজ সকালে সহ্যের বাঁধ ভাঙে বাবা-মায়ের, আর ভীষণ বকুনি জোটে অনুপমার কপালে। ব্যাস তারপর আর কি, একেই ক্লাস ইলেভেনের মেয়েরা প্রেম নিয়ে একটু বেশি সতর্ক থাকে তার ওপর অনুপমা হল স্বভাবে বদমেজাজী; তাই স্বভাববসত কাউকে কিচ্ছুটি না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সে। অনুপম লাঞ্চটাইমে অফিস থেকে ফিরে দেখে এই কান্ড।

“ওগো, এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটা বেরিয়ে গেল, কোথায় গেল একটু দেখো না।”

    মায়ের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে একটা চিন্তা আর রাগ মেশানো দৃষ্টিতে বাবা অনুপমের দিকে তাকায়।

অনুপম মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “এই অচেনা শহরে একা একা আর কোথায় যাবে! আশেপাশেই কোথাও আছে নিশ্চয়ই।”
“না রে, সেই সকালে বেরিয়েছে। আশেপাশে থাকলে এতক্ষণে ফিরে আসত ঠিকই। আমার মনে হয় সে তোদের পাঁচুমামার হোটেলে গিয়েছে। কয়েকদিন ধরেই যাবে বলছিল।”
“কি! সে তো দার্জিলিঙে। একা একা এতদূর চলে যাবে!”
“আগে তো এমন স্বভাব ছিল না আমার মেয়েটার। তোর বন্ধুদের পাল্লায় পড়েই উচ্ছ্বন্নে যাচ্ছে।” গম্ভীরভাবে বললেন বাবা।
“কি, আমার বন্ধুদের!”
“কি বেশ নাম ছিল ছেলেটার, হ্যাঁ সুনীল; তোর মুখেই তো শুনতাম সেও নাকি বাড়িতে রাগারাগি করে বেরিয়ে চলে যেত কোথাও, তারপর আবার দু-তিন দিন পরে ফিরত। ওর বাবার সঙ্গে নাকি ঝামেলা লেগেই থাকত ছেলেটার। ছোটবেলায় অনুপমা তো যেত ওদের বাড়ি, ওর কাছ থেকেই নিশ্চয়ই শিখেছে; বাবা-মায়ের কথা না শোনা, কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে যাওয়া এইসব।”
“সুনীলদার সঙ্গে শেষ দু’বছর ধরে কোনো যোগাযোগ নেই বাবা, আর অনুপমা এগুলো রিসেন্টলি করা শুরু করেছে; তাই প্লিজ অকারণে সুনীলদাকে দোষারোপ করো না।” বিরক্তিসূচক গলায় বলল অনুপম, “মা, তুমি পাঁচুমামাকে ফোন করো একটা।”

    মা ফোনে রি-ডায়াল করতে করতে বলে, “সকাল থেকে অনেকবার চেষ্টা করেছি রে, ওকে ফোনে পাইনি। আর মেয়েটার কাছেও তো কোনো ফোন নেই। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে বাবা, তুই কিছু একটা কর।”

    আরও কিছুক্ষণ আলোচনা করে অনুপম অফিস থেকে লিভ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে পাঁচুমামার হোটেলের উদ্দেশ্যে, দার্জিলিঙে। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি, অর্ধেকটা রাস্তা যাওয়ার পরেই থেমে যায় গাড়ি। শেষ তিনদিন ধরে ভীষণ বৃষ্টি হওয়ায় কার্শিয়াঙে ল্যান্ডস্লাইড হয়েছে, দার্জিলিঙ যাওয়ার রাস্তা তাই বন্ধ। ভীষণ যানজট, মনমরা টুরিস্টদের নিয়ে একে একে সব গাড়িগুলো শিলিগুড়ি ফিরে যাচ্ছে। আর অনুপম পড়লো চিন্তায়— ওকে তো দার্জিলিঙ যেতেই হবে, বোনের খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই তার।

।।৩।।

    হোটেলের লবিতে বসে অনেকক্ষণ মন দিয়ে ম্যাগাজিনগুলো পড়ছিল সন্দীপ, দিন দুয়েক হল মাসিদের সঙ্গে বেড়াতে এসেছে সে দার্জিলিঙে। মাসি আর মেসো অনেকক্ষণ আগে ঘুম থেকে উঠেই মহাকাল মন্দিরে গেছে পুজো দিতে, দিদি সদ্য ঘুম থেকে উঠে দুকাপ গরম কফি নিয়ে লবিতে এসে বসল। সন্দীপ বেশ বিরক্তিসূচক মুখভঙ্গী করে টি-টেবিলের ওপর বেশ জোরে ম্যাগাজিনটা রাখতেই দিদি বলল, “কি রে ভাই, এতো বিরক্তি কিসের? গল্পগুলো ভালো নয় বুঝি?”
“ধুর, আমি কি আর গল্প পড়তে এখানে এসেছি! আসা থেকে একবারও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেলাম না, কোনো মানে হয়!”
“যা মেঘ করে আছে, দেখবি কিভাবে! এরকম হয় অনেকসময়। তবে এখনই মনখারাপ করিস না, আরও দু’দিন তো আছি— হয়তো তোর ভাগ্যে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন থাকতেও পারে।”

সন্দীপ কোনো উত্তর না দিয়ে আবার ম্যাগাজিনটা তুলে পড়তে লাগল। দিদি কফিটা শেষ করে বলল, “ভাই, একটা কথা বলবি?”
“হুমম।”
“তুই আজকাল প্রতিমাসে এতোগুলো ম্যাগাজিন ফোলো করিস কেন রে?”

    দিদির এই অদ্ভুত প্রশ্নটা শুনে সন্দীপ ম্যাগাজিনটা নামিয়ে বলে, “এ আবার কেমন প্রশ্ন?”
“না মানে, তুই তো আগে শুধু পুরোনো, একটু দুস্প্রাপ্য ম্যাগাজিনগুলো সংগ্রহ করতিস। এখনকার মাসিক পত্রিকাগুলো, যেখানে মূলত গল্প বেরোয়, এতো নিয়মিত পড়তে তো দেখতাম না আগে। শেষ এক-দেড় বছর ধরে দেখছি, তুই এখনকার ম্যাগাজিনগুলো প্রতিমাসে ফোলো করছিস। কি ব্যাপার বল তো?”
“আরে এ আর কি এমন ব্যাপার! একটা গল্প পড়ার পর যে মজা পাওয়া যায়, সে কি আর প্রবন্ধ পড়ে মেলে! তাই পড়ছি।”
“না, সত্যি করে বল।”
“আরে সত্যিই তো।”
“সুনীলদার কোথাও কোনো লেখা বেরিয়েছে কিনা, সেটা দেখার জন্য তুই রেগুলার ফোলো করিস বল?”

    দিদির এই কথাটা শুনে সন্দীপের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, “আমি বরাবরই ফোলো করতাম দিদি। আগে আমাদের মধ্যে কেউ না কেউ কিনতই, তাই ধার করে পড়তাম আর এখন নিজে কিনি।”
“সেই কেউ বলতে, কেউ টা কে? সুনীলদা তো?”

    সন্দীপ কোনো উত্তর না দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে যায়। দিদি আবার বলে, “তুই এখনও মিস করিস বল ওকে? কি হয়েছিল রে তোদের মধ্যে? একবার ফোন কর না, মিটিয়ে নে।”

    সন্দীপ জানলার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বাইরের গাঢ় মেঘে যেমন চাপা পড়ে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা, ঠিক তেমনই মনোমালিন্যের আস্তরণে চাপা পড়ে গেছে ওদের বন্ধুত্ব। মাসির ডাকে সম্বিৎ ফেরে সন্দীপের, “তোর মা ফোন করেছিল। তোর ঠাকুমা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তোকে ফিরতে বলছে… হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন! তাড়াতাড়ি আজকে আমাদের ফেরার টিকিটের ব্যবস্থা করো।”

    শেষ কথাটা মেসোর উদ্দেশ্যে বলতেই মেসো তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ফোন বের করতে গিয়ে হাত থেকে ফেলে তারপর একটু কাঁদোকাঁদো মুখ করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া ফোনের অংশগুলো কুড়োতে শুরু করে। মেসোর করুণ অবস্থা দেখে সন্দীপ বলে, “মাসি, আমার মনে হয় তোমাদের ফেরার দরকার নেই, আমি একাই আজকে ফিরি। তোমরা ধীরেসুস্থে এসো।”

    মেসোও সেকথায় সায় দিয়ে বলে, “ও ঠিকই বলছে, এতো তাড়াতাড়ি চারজনের রিজারভেশন পাওয়া খুব মুশকিল। আজকে বরং ও একাই ফিরুক, আমি ঋতেশকে বলে দিচ্ছি সন্দীপকে শিলিগুড়ি থেকে যেন একটা ট্রেনে উঠিয়ে দেয়।”

    মাসি মুখ ভেঙ্চিয়ে বলে, “তুমি তো বলবেই, তোমার তো খাটনি কমে গেল কিনা! এই বৃষ্টি-বাদলার দিনে ছেলেটাকে কেউ একা পাঠায়!”

    মাসিকে রাজী করাতে আরও আধঘন্টা মতো লাগল সন্দীপের, তারপর ব্যাগপত্র গুছিয়ে ঋতেশের গাড়িতে রওনা দিল শিলিগুড়ির দিকে।

।।৪।।

“দাদা, আর তো মনে হচ্ছে এগোনো যাবে না।”
“অন্য কোনো রাস্তা দিয়ে যাওয়া যায় না?”
“যেত কিন্তু পিছনেও যা জ্যাম লেগে গেছে, গাড়ি আর ঘোরানো যাবে বলে মনে হয় না।”

    ঋতেশের কথাটা শুনে গাড়ি থেকে নামল সন্দীপ, এখনও বৃষ্টি পড়ছে। যে লোকগুলো আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে, ল্যান্ডস্লাইডের এই ঝঞ্ঝাটের কারণে তাদের সবার মেজাজ বিগড়ে রয়েছে; সন্দীপেরও তাই। খানিক দূরে একটা চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। অন্য একটা জায়গায় এসে, এরকম একটা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পরিচিত কোনো মুখ দেখলে মন খুশি হয়ে যাওয়ারই কথা, কিন্তু নিজের থেকে ঠিক দশহাত দূরে যার সাথে সন্দীপের চোখাচোখি হল তাকে দেখে সে বেশ অস্বস্তিতেই পড়ল। দোকানের একটু পাশে দাঁড়িয়ে অনুপম চা খাচ্ছে। সন্দীপ আর অনুপমের ‘চা-খোর’ হিসেবে বেশ একটা বদনাম ছিল, বাইরে বেরোলেই একসাথে চা খাওয়া ছিল ওদের নিত্য অভ্যেস। তবে দুবছর পরেও যে সেই অভ্যেস অব্যহত থাকবে, তা স্বপ্নেও ভাবেনি ওরা। এরকম বিপদের মধ্যে এতটা কাছাকাছি দাঁড়িয়েও, না দেখার ভান করে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটা চরম অভদ্রতা, তাই এগিয়ে গিয়ে খানিকটা ফরম্যালি সন্দীপ জিজ্ঞেস করল, “কি রে, কেমন আছিস?”

সন্দীপকে দেখামাত্রই বিস্ময়, আনন্দ আর অভিমানের মিশ্র অনুভূতি তৈরী হয়েছে অনুপমের মনে। তাই কোনো উত্তর না দিয়ে চায়ের কাপটা ফেলে জড়িয়ে ধরল তাকে। সন্দীপের মনেও একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল, অকারণেই অনুপমকে এড়িয়ে চলেছে এতোদিন ধরে। তাই এই আলিঙ্গন ওর মনেও একটা স্বস্তির সঞ্চার করল। বন্ধুকে দেখামাত্রই সমস্ত অভিমান ভুলে গেল অনুপম। সন্দীপের হাত শক্ত করে ধরে বলল, “তুই কেমন আছিস বল? রোগা হয়েছিস আরো? আর এখানে কি করছিস?”
“দাঁড়া, আগে চা টা শেষ করতে দে, তারপর বলছি সব।”
“ওপরে ঐ গাছতলাটায় গিয়ে বসি চল।”
“হুমম চল, তার আগে চারটে সিগারেট কিনে আন তো।”

    শুধুই সিগারেট নয়, আরো দু’কাপ চা সহযোগে শুরু হল ওদের আড্ডা। এই ক’দিন কে কি করেছে, এখন কি করছে, এখানে কি করছে— এইসব। দুজনেই ইচ্ছাকৃতভাবে সুনীলদার প্রসঙ্গ ওদের আলোচনা থেকে বাদ দিল, কিন্তু অনুপমের মনে সেই পুরোনো প্রশ্নটা আবার খটখট করতে লাগল, “ঠিক কি হয়েছিল?”

    এমন সময় ঋতেশ এসে হাজির হল ওদের কাছে, “দাদা, আজ কোনোভাবেই যাওয়া যাবে না। যা বুঝছি কাল বিকেল হয়ে যাবে রাস্তা ঠিক করতে।”
“ঠিক আছে, আমি মা-কে ফোন করে দিচ্ছি। ঠাকুমার আগেও এরকম হয়েছিল, মা খামোখা বেশি চিন্তা করে।”
“কিন্তু আমাকে তো একবার দার্জিলিঙ যেতেই হবে রে, বোনকে না পাওয়া পর্যন্ত আমার মায়ের তো চিন্তা কমবে না।”
“তা তো ঠিকই, অন্য কোনোভাবেই কি আজ দার্জিলিঙ যাওয়া যাবে না ঋতেশ?”
“না দাদা, এখন তো সন্ধ্যে নামতে চলল। আপনাদের মনে হচ্ছে আজ এখানেই কোথাও থাকতে হবে।”
“এখানে মনে হয় না কোনো হোটেল ফাঁকা পাব বলে। আমি তো সেই দুপুর থেকে আছি। সমস্ত লোকই আশপাশের সব হোটেলগুলো কব্জা করে ফেলেছে।”
“তবে একটু দূরেই একটা হোটেল আছে দাদা, সেটা ফাঁকাই থাকবে।”

    ঋতেশের কথাটা শুনে অনুপমের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীরভাবে বলল, “আমি যেটা ভাবছি, তুমি কি সেটাই বলছ?”

    ঋতেশ মুখে কিছু না বলে মাথাটা সামনের দিকে দু’বার নাড়ালো। সন্দীপ এতক্ষণ হাঁ করে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল, এবার বলল, “কেসটা কি?”

    ঋতেশ ওপরে একদিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ঐদিকে সোজা গেলেই ফরেস্ট অফিস আর তারপাশেই ডাউনহিল জঙ্গল। অফিসের ঠিক সামনে থেকেই একটা সোজা রাস্তা চলে গেছে জঙ্গলের ভেতর। ঐ রাস্তা দিয়ে খানিকক্ষণ হাঁটার পর ভিক্টোরিয়া বয়েজ স্কুল দেখতে পাবেন আর তার ঠিক পাশেই রয়েছে একটা ছোট্ট ফরেস্ট বাংলো। আপনারা একমাত্র ওখানে গেলেই ঘর ফাঁকা পাবেন।”

    জঙ্গলের নাম শুনেই বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল সন্দীপ, “ভালোই তো, চল তবে।”

    মুখটা একটু থমথমে করে অনুপম বলল, “তোর মনে হল না একবারও, যে ওখানে গেলেই ঘর ফাঁকা পাব কেন?”
“কেন? কি ব্যাপার?”
“ভিক্টোরিয়া বয়েজ স্কুল আর তার লাগোয়া এই ডাউন হিল জঙ্গল, ভারতের অন্যতম একটা হন্টেড প্লেস। এই পাহাড়ি জঙ্গল সকালে যতটা সুন্দর, সন্ধ্যের পর ঠিক ততটাই ভয়ঙ্কর। ঐ যে ফরেস্ট অফিস থেকে বয়েজ স্কুল পর্যন্ত যে সোজা রাস্তাটার কথা ঋতেশ বলল, রাস্তাটার নাম কি জানিস? ডেথ রোড। এই জঙ্গলে অনেক খুন, অপমৃত্যু, আরো অনেক অলৌকিক সব ঘটনা ঘটেছে। এখানে আসার পর শুনেছিলাম, স্কুলের ছাত্ররা আর লোকাল কিছু মানুষ প্রায়ই নাকি একটা মুন্ডুকাটা ভূতের খপ্পরে পড়ে। তাই ওখানে কেউ যায় না, ঘরগুলো ফাঁকাই থাকে।”

    এখানকার ভুতুড়ে কাহিনীটা ঠিক বিশ্বাস না হলেও যেহেতু সন্ধ্যেবেলাতেই ওদের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, তাই একটু হলেও বুকটা ঢিবঢিব করে উঠল সন্দীপের।

    ঋতেশ বলল, “এখান থেকে একটু এগোলেই বয়েজ স্কুল যাওয়ার একটা শর্টকাট আছে। কাল ভোরের দিকে জ্যাম একটু ছাড়লেই আমি গাড়ি নিয়ে পৌঁছে যাব বাংলোয়। তারপর ঐদিক দিয়ে আপনাকে দার্জিলিঙ পৌঁছে দিয়ে সন্দীপদাকে আবার শিলিগুড়ি দিয়ে আসব। ওখানে যে রান্না করে, নিমো, তাকে আমি চিনি। ফোন করে বলে রাখছি যে আপনারা যাচ্ছেন।”
“আমার মনে হয় ঋতেশ ঠিকই বলছে, কাল ভোরের দিকে দার্জিলিঙ গিয়ে তুই আর আমি একসাথেই অনুপমাকে খুঁজব, ওকে না পাওয়া পর্যন্ত আমিও শিলিগুড়ি ফিরব না।”
“চল তবে।”

    চায়ের দোকান থেকে আরও এক কাপ করে চা খেয়ে আর কিছু সিগারেট কিনে দুই বন্ধু চলল ডাউনহিল জঙ্গলের দিকে।

।।৫।।

“কতদিন হল তুমি এখানে আছ?”
“সে প্রায় বছর দেড়েক।”
“এরকম এক পান্ডববর্জিত জায়গায় কাকিমা ছাড়লো?”
“স্থানীয় একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচিতি ছিল, সেই এই কেয়ারটেকারের চাকরিটা অফার করল আর চাকরি পাওয়ার পর মা কি আর আঁচলে বেঁধে রাখতে পারে! প্রথমে একটু আপত্তি জানিয়েছিল, তারপর মেনে নিয়েছে।”
“তোমার ভালো লাগে এভাবে একা একা থাকতে?”
“আমার তো বরাবরই একা থাকতে ভালো লাগে। এছাড়াও এই পাহাড়, কুয়াশা, জঙ্গল এগুলোর একটা আলাদা আকর্ষণ আছে; কটা দিন থাক বুঝবি।”

    আধঘন্টা হতে চলল সুনীলকে এভাবেই জেরা করে চলেছে অনুপমা। এতদিন পর প্রিয় দাদার সঙ্গে দেখা; তাই মনে যা যা প্রশ্ন আছে সব উগরে দিচ্ছে আর সুনীলও একটুও বিরক্ত না হয়ে একের পর এক জবাব দিয়ে চলেছে। ওর মায়ের সন্দেহই ঠিক, আজ সকালে বাড়ি থেকে ঝগড়া করে একটা শেয়ার গাড়িতে উঠে পড়ে দার্জিলিঙ যাবে বলেই, কিন্তু কার্শিয়াঙের ল্যান্ডস্লাইডে আটকে পড়ে গাড়ি। আর অনুপমাদের গাড়ির পিছনেই এক ম্যাটাডর ভর্তি বাজার করে শিলিগুড়ি থেকে ফিরছিল সুনীল। সুনীলকে সেখানে দেখামাত্রই ওর ম্যাটাডরে চেপে চলে আসে এই ডাকবাংলোয়। দুপুরবেলায় সুনীল নিজে রান্না করে অনুপমাকে ভাত, ডাল, আলুভাজা আর মুরগীর মাংস খাওয়ায়। কথা ছিল বিকেলে সুনীল নিজেই ওকে শিলিগুড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে, কিন্তু বিকেলের পর থেকে বৃষ্টি আরও বাড়ায় আর রাস্তার অবস্থাও বেগতিক থাকায় বাড়ি ফেরার প্ল্যান পিছিয়ে গেল। আধঘন্টা আগেই ঘুম থেকে উঠে, আজ বাড়ি না ফেরার খবরটা শুনে আনন্দে নেচে ওঠে সে আর তারপরেই সুনীলদাকে সামনে বসিয়ে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করতে থাকে।

“আচ্ছা সুনীলদা, তুমি আর কোথাও কিছু লিখছ না কেন?”
“একটা গল্প আমাকে তাড়া করে বেরোচ্ছে শেষ দু’বছর ধরে, তার শেষ না দেখা পর্যন্ত অন্য কিছু লিখতে পারছি না।”
“ম্যানুস্ক্রিপ্টটা দেখাবে আমাকে?”
“দেখাবো, আগে শেষ হোক গল্পটা।”
“তুমি কি এই গল্প লিখতেই আমাদের ছেড়ে এখানে চলে এলে? সন্দীপদাও আর আমাদের বাড়ি আসে না। দাদাকে জিজ্ঞেস করলেও সে কিছু বলে না।”
“আরে আমাদের মধ্যে ঝগড়া হল যে, তারপর একটু ছাড়াছাড়ি তো হয়। যেকোনো সম্পর্কেই ঝগড়া মাস্ট। এই যে তুই এখন জমিয়ে প্রেম করছিস, তো তোদের মধ্যে ঝগড়া হয় না?”

    ব্যাস, প্রেমের প্রসঙ্গ উঠতেই অনুপমার কথা বলার ক্ষমতা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল, ওদের প্রেমের ইতিহাস, রসায়ন ইত্যাদি বর্ণনা করতে লাগল সুনীলদার কাছে। প্রায় দশ মিনিট টানা বলার পর বেয়ারার ডাকে ওকে থামতে হল, “সাব, একটু আসবেন। দরকার আছে।”
“আসছি। আর তুই কফি খাবি? এতক্ষণ কথা বলে গলা শুকিয়ে গেছে নিশ্চয়ই।”
“হ্যাঁ, প্লিজ।”

    সুনীল খাট থেকে উঠে যায়।

“আচ্ছা সুনীল দা, আমাদের মধ্যে ঝগড়া তো মিটে যায়। তোমাদেরটা কবে মিটবে?”

    সুনীল সে কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ওর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে দু’কাপ কফি নিয়ে ঘরে ঢোকে সুনীল; তারপর অনুপমা কে বলে, “তোর শেষ প্রশ্নটা কি ছিল বেশ?”
“ওই তো, তোমাদের ঝগড়া কবে মিটবে?”

    সুনীল একগাল হেসে বলে, “আজকেই।”

।।৬।।

    ভুতুড়ে অধ্যায়টা বাদ দিলে এই জঙ্গলের রোমাঞ্চকর মায়াবী পরিবেশে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। বৃষ্টি এখন একেবারেই কমে গেছে, গাছগুলো সব সারি বেঁধে কুয়াশার চাদর জড়িয়ে বৃষ্টির জল ঝরাচ্ছে। সন্দীপ আর অনুপম এখন জঙ্গলের ঠিক মাঝখানে, তবে ডাকবাংলো পৌঁছতে আরও খানিকটা হাঁটতে হবে ওদের। এরকম একটা পরিবেশে হাঁটতে মন্দ লাগে না, তবে ভূতের আশঙ্কাটা মনে গেঁথে যাওয়ায় হাল্কা কোনো আওয়াজ শুনলেই চমকে উঠে এদিকে ওদিকে তাকাতে হচ্ছে। অনুপম বলল, “কি রে, গুম মেরে গেলি যে, ভয় লাগছে নাকি?”
“না না, তোর?”
“আমারও নয়।”

    আবার দুজনে চুপ। এভাবেই হাঁটছে ওরা— কিছুটা রাস্তা কথা বলছে আবার নির্বাক। প্রতিবারই কথা শুরু করছে অনুপম, কেননা যে প্রশ্নের জবাব দু’বছর ধরে ভাবিয়ে তুলেছে ওকে, তার জবাব আজ তার চাই। কিন্তু ঠিক কিভাবে কথাটা শুরু করবে বুঝতে পারছে না, তাই নানারকম অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ টেনে জিজ্ঞেস করার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। এবার মনে বেশ জোর টেনে একটা প্রাসঙ্গিক কথা বলল, “মনে আছে, সুনীলদা কত পাহাড় ভালোবাসত। শুধু বলত, পাহাড় নিয়ে গল্প লিখব, পাহাড়ে বাড়ি বানাব। এবার এখানে এসে ওকে বেশ মিস করছি, কি বলিস?”

    অনুপম ভেবেছিল সন্দীপ হয়তো কোনো উত্তর দেবে না অথবা এড়িয়ে যাবে, কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবেই সে বলল, “হুমম। এই “হুমম”-এর মধ্যে খানিকটা বেদনা ছিল আর অনেকটা অভিমান। অনুপম এবার সন্দীপকে থামিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, “এবার বলবি ঠিক কি হয়েছিল?”

    সন্দীপ কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে হাঁটতে শুরু করল, “তুই অথবা আরও অনেকেই যেরকম আশা করছে, তেমন বড়ো কিছুই হয়নি আমাদের মধ্যে। ব্যাপারটা দেখতে গেলে খুবই ছোট, কিন্তু সিগনিফিকেন্ট।”
“একটু পরিষ্কার করে বলবি?”
“তোর সবুজকলি পত্রিকার কথা মনে আছে? আমরা যেখানে লিখতাম।”
“হ্যাঁ, তবে মৃদুলদার অ্যাক্সিডেন্টের পর সে পত্রিকা তো বন্ধ হয়ে গেছে।”
“হুমম শুনেছি। সেই পত্রিকায় তো সুনীলদা গল্প লিখত টুকটাক আর আমি প্রবন্ধ। তবে আমিও একটা গল্প পাঠিয়েছিলাম ওখানে।”
“তুই গল্প পাঠিয়েছিলি? জানতাম না তো।”
“আমি কাউকেই বলিনি, ভেবেছিলাম বেরোলে সারপ্রাইজ দেব। তবে মৌলিক গল্প নয়, তুই জেমস জয়েস-এর ‘A Little Cloud’ পড়েছিস? তারই বঙ্গানুবাদ করেছিলাম, ‘এক টুকরো মেঘ’। মৃদুলদাকে লেখাটা দেখাতেই বলল ওদের পত্রিকাতে পাঠাতে, আমিও পাঠিয়ে দিলাম। মাসখানেক পরে মৃদুলদা আমাকে খুব রেগে একদিন ফোন করে জানায় কিছু ব্যক্তিগত কারণে সে লেখাটা ছাপবে না। আমি চিন্তায় পড়ে যাই, পরের দিন ওদের দপ্তরে গিয়ে জানতে পারি সুনীলদা নাকি আমার নামে অনেক খারাপ কথা বলেছে। আমি নাকি ওদের পত্রিকাকে থার্ডক্লাস পত্রিকা বলেছি, মৃদুলদাকে নাকি অশিক্ষিত বলেছি এইসব। আমি প্রথমে মানতে চাইনি, তারপর মৃদুলদা আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে এই অডিও রেকর্ডটা পাঠাল।”

    সন্দীপ পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে রেকর্ডিংটা চালালো, পরিস্কার সুনীলের গলা, “আমার মনে হয় সন্দীপের গল্পটা সবুজকলিতে না ছাপাই ভালো।”

    সন্দীপ মোবাইলটা আবার পকেটে ঢোকাতেই অনুপম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো, “সুনীলদা হঠাৎ এমনটা কেন করল?”
“খুব সোজা। হিংসে অথবা কূটনীতি— যা বলবি। আমার গল্প লেখাটা নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখেনি, ভেবেছিল হয়তো আমিও গল্প লিখতে শুরু করলে যদি ওর লেখার সুযোগ কমে যায়। তাই মৃদুলদার কাছে আমার নামে মিথ্যে কথা বলে আমার গল্পটা বাতিল করালো, যাতে নিজেরটা ছাপাতে পারে।”
“কিন্তু সুনীলদারও তো তারপর আর কোনো গল্প বেরোয়নি সবুজকলিতে। আচ্ছা ওটা যে সুনীলদারই ভয়েস, তুই নিশ্চিত?”
“আমি অডিওটা ওকে ফোরওয়ার্ড করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভয়েসটা তোমার কি না? প্রথমে একটা অবাক হওয়ার ইমোজি পাঠায় আর তারপর বলে ‘হ্যাঁ’।”
“তারপর? তারপর কি বলল?”
“আমি আর কিছু শোনার প্রয়োজন বোধ করিনি। পাঁচটা খারাপ কথা লিখে ওকে ব্লক মেরে দিয়েছি, তারপর নম্বরও পাল্টে ফেলেছি।”
“আহা, একবার ওর এক্সপ্লেনেশনটা তো শুনতে পারতিস।”
“মিথ্যেই বলত আবার। এরকম মানুষের থেকে যত দূরত্বে থাকা যায় ততই মঙ্গল।”

।।৭।।

    এতক্ষণের এই সিরিয়াস আলোচনায় ওরা ভূতের প্রসঙ্গটা ভুলেই গিয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ একটা পায়ের শব্দে পিছন ফিরে তাকাল। অনুপম পিছনে টর্চ মেরে কাউকে দেখতে পেল না, কিন্তু এই মূহুর্তে ওরা দুজন ছাড়াও এই জঙ্গলে আর একজন অথবা একাধিকজন যে উপস্থিত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যতটা সম্ভব দ্রুত গতিতে ওরা বাংলোর দিকে এগোতে থাকল, কিন্তু বেশিক্ষণ পারল না; সামনে থেকে আসা এক ভীষণ দমকা হাওয়ার ঝাপটে থামতে হল ওদের। চারপাশ গাঢ় অন্ধকার আর চারপাশ থেকেই ভেসে আসছে পায়ের শব্দ, নানারকম কলরব। এই শীতেও দুজনের কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম দেখা দিল, হঠাৎ একটু দূরে একটা গাছের নীচে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় আগুন জ্বলে উঠল। আগুনের কাছে পৌঁছতেই ওরা দেখল কেউ যেন সদ্য কিছু কাঠ জোড়ো করে আগুন ধরিয়েছে, ঠিক যেন বনফায়ার। আগুনের ঠিক পাশেই অনুপম খেয়াল করল একটা কাগজ পড়ে রয়েছে আর সেটা যাতে উড়ে না যায় তাই একটা ছোট্ট পাথর চাপা দেওয়া। পাথরটা সরিয়ে কাগজটা তুলতেই অনুপম চমকে গেল, সেটা সন্দীপের হাতে দিতে সে-ও অবাক— সুনীলদার চিঠি। সুনীলদার সেই খারাপ হাতের লেখায় লেখা, যেন খুব তাড়াহুড়ো করে লিখেছে।

সন্দীপ,

তুই বড্ড মাথা গরম করিস। যদি মাথা ঠান্ডা রেখে সেদিন আমার সাথে কথা বলতিস তাহলে এত কিছুই হত না। আর রাগের থেকেও যা তোর বেড়েছে তা হল ইগো, বড্ড নাকউঁচু হয়ে গেছিস। যদিও সে ইগোর প্রবলেম আমারও আছে, আমাকে উল্টোপাল্টা বলে যখন ব্লক করে দিলি ,তারপর যদি ইগো না দেখিয়ে ডিরেক্টলি তোর বাড়ি চলে যেতাম, তাহলেও এত কিছু হত না। দোষটা আমার আরও বেশি, কেন না আমি বড়। যাই হোক, কি হয়েছিল বলি এবার— আমরা যে ত্রৈমাসিকটা চালাতাম, মনে আছে? সেটা যখন বেশ নামডাক করল, তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম যে মাসিক করব। আমাদের এই সিদ্ধান্তটা কিভাবে জানিনা পাঁচ কান হয়ে গিয়েছিল। আর অন্যান্য কিছু সংগঠন চেষ্টা করতে লাগল কিভাবে আমাদের পত্রিকাটাকে আটকানো যায়। অনেকে অনেকরকম চেষ্টা করেও পারল না, শেষে সবুজকলি পত্রিকার মৃদুল নাথ এক মোক্ষম বুদ্ধি বের করলেন, যদি আমাদের মধ্যে বিভেদ তৈরী করা যায় তাহলেই একমাত্র আমাদের পত্রিকাটাকে বন্ধ করা যাবে। আর অদ্ভুতভাবে সুযোগও চলে এল ওর হাতে। তুই জেমস জয়েসের একটা গল্প অনুবাদ করে পাঠালি, তারপর সে একদিন ফোন করে আমাকে ওদের দপ্তরে ডাকল। আমি যেতেই আমার হাতে তোর লেখাটা ধরিয়ে বলল, “সন্দীপ কি পাঠিয়েছে দেখো। জেমস জয়েসের একটা গল্প হুবহু টুকে দিয়েছে। তোমরা সবাই কি এভাবে টুকেই গল্প লেখো?”
গল্পটা খানিকটা পড়েই বুঝলাম সেটা ‘A Little Cloud’ এর মতোই। আমার খারাপই লাগল। বললাম, “আমার মনে হয় গল্পটা সবুজকলিতে না ছাপাই ভালো।” আরও কিছুক্ষণ বসে খারাপ কথা শোনার পর বাড়ি ফিরলাম। ফিরে দেখি তোর মেসেজ। মৃদুলদা কখন জানিনা শুধু আমার কথাটুকুই রেকর্ড করে তোকে পাঠিয়েছে। আর তুইও যথারীতি ভুল বুঝে আমাকে খারাপ কথা শোনাতে লাগলি। আমি তখন মৃদুলদার পুরো প্ল্যানটা বুঝতে পারলাম, তোর থেকে একটা অনুবাদ গল্প চেয়ে নিয়ে সেটাকে টোকা গল্প বলে চালাচ্ছে। তারপর তোকে সবটা বলতে গিয়ে দেখি আমাকে ব্লক করে দিয়েছিস, ফোনও ‘সুইচড অফ’। আমার তখন রাগ হল বেশ, আরও বেশি খারাপ লাগল। তারপর তো আর কথাই হল না।
আর অনুপম,
তুই কি কারণে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করলি জানিনা, হয়তো সেই ইগো প্রবলেম। এই ইগো-ই আমাদের বন্ধুত্বটাকে খেয়ে ফেলল। খারাপ সময়ে আমরা যদি একে অপরের প্রতি বিশ্বাসটা না হারাতাম, তাহলে বোধহয় ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ ভাঙতো না।

পুনশ্চ : দপ্তর থেকে রাত করে বাড়ি ফেরার সময় মৃদুলদার যে অ্যাক্সিডেন্টটা হল, তার পিছনে আমার পালসার ১৫০বাইকটা দায়ী ছিল।

সুনীলদা

    চিঠিটা শেষ করার পর এক তীব্র অনুশোচনায় সন্দীপের মন ভরে গেল, অনুপম ওকে আশ্বস্ত করতে ওর কাঁধে হাত রাখল। মায়াবী জঙ্গল, অন্ধকার, অশরীরির উপস্থিতি সবকিছু ভুলে শুধু সুনীলদার কথা ভাবতে লাগল ওরা। হঠাৎ দূর থেকে আসা ঘোড়ার পায়ের আওয়াজে চমকে উঠল, কেউ একজন ঘোড়ায় চেপে আসছে। ঘোড়াটা কাছে আসতেই আগুনের আলোয় স্পষ্ট দেখল ঘোড়সওয়ারীর পরনে একটি কালো ওভারকোট, কালো প্যান্ট, কালো জুতো আর কাঁধের ওপরে মাথার পরিবর্তে রয়েছে শুধুই একটা কালো হ্যাট। এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে সন্দীপ আর নিজেকে সামলাতে পারল না, অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। অনুপম তাড়াতাড়ি মাটিতে বসে ওর হুঁশ ফেরাতে কাঁপা হাতে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করতে গেল। ঠিক তখনই কেউ একজন খিলখিলিয়ে পিছনদিকে হেঁসে উঠল। সেদিকে তাকিয়ে চমকে গেল অনুপম, ঠিক দশহাত দূরে যে দাঁড়িয়ে আছে সে তার বোন অনুপমা। কিন্তু, এ কেমন ভয়াবহ রূপ তার, গোটা মুখে যেন রক্ত লেগে, চোখে হিংস্রতা; যেন কোনো পিশাচিনি ভর করেছে ওর ওপরে। অনুপমের মাথাও বোঁ বোঁ করতে লাগল, পড়ে গেল সন্দীপের ঠিক পাশেই।

।।৮।।

    জানলা দিয়ে রোদ আসছে আর আসছে নানারকম পাখির ডাক, সেই ডাক শুনেই ঘুম ভাঙলো সন্দীপের। পাশেই শুয়ে আছে অনুপম, খাট থেকে নেমে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মন ভরে গেল তার। অনেকদিন পর রোদ উঠেছে, পাহাড়গুলো যেন স্নান করছে সে আলোয়। আজ সমস্ত মেঘ কেটে গেছে, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। অনুপমও উঠে পড়েছে ততক্ষণে, কিন্তু ওরা কোথায় আছে, কেন আছে কিছুই বুঝতে পারল না। হঠাৎ দরজা খুলে চার কাপ কফি নিয়ে সুনীলদা ঢুকলো, আর তার পিছন পিছন অনুপমা।

“তোদের ওপর বড্ড রাগ হচ্ছে রে, আমি আর অনুপমা মিলে এত প্ল্যান করে, নাটকীয়ভাবে তোদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম; আর তোরা ব্যাটা আমাকে দেখার আগেই হুঁশ হারালি!”

    সুনীলদার কথা শুনে কে বলবে যে ওরা আবার দু’বছর পর কথা বলছে, ও এতটাই স্বাভাবিক রয়েছে যে ওকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। অনুপমও আর পুরনো কাসুন্দী ঘাঁটতে চাইল না, কিন্তু অবাক হয়েই বলল, “মানে কালকের জঙ্গলের ঘটনাগুলো তোমার কারসাজি ছিল? মানে ‘ডাউনহিলের ভূত’ আসলে তুমি? আর ওকে কোথায় পেলে?”
“আহা, আমি কেন ভূত হতে যাব! এখানকার ভূতের গল্প আমার জন্মের আগে থেকেই চলে আসছে। আমি যদিও কোনো ভূত দেখিনি, তবে এই ভূতের গল্পটাকে একটু ভালো কাজে লাগাই আর কি! এই জঙ্গলে মাঝেমাঝেই কাঠের চোরা ব্যাবসায়ীদের আগমন ঘটে, তাই আমরা হোটেলের সবাই মিলে প্ল্যান আর মেকাপ করে ওদের ভয় দেখাই, যাতে ওরা আর বেআইনিভাবে জঙ্গলের কাঠ কাটতে না পারে। আর অনুপমার সঙ্গে তো কাল দুপুরে দেখা, কত করে বললাম বাড়িতে জানাতে, জানালোই না। তুই একবার কাকিমাকে ফোন করে জানিয়ে দে।”
“উফ, তুমি পারোও বটে। কিন্তু তুমি জানলে কিভাবে যে আমরা এখানে আসছি?”
“আমাদের যে রান্না করে নিমো, সে জানায় যে দুজন বাবু আসছেন। খুব বিপদ না হলে তো কেউ এখানে সচরাচর আসে না। অনুপমা নিখোঁজ, তাই তুই আসবি এমন একটা সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে আরেকজন কে! সেটা ডিটেলসে জানতে নিমোর থেকে তোদের ড্রাইভার ঋতেশের নম্বর নিয়ে ওকে ফোন করি, কথা বলার পর বুঝতে পারি আপনারা দু’জনই আসছেন। তাই ভাবলাম একটু নাটকীয়ভাবেই যেন ভুল বোঝাবুঝিটা দূর করা যায়। তাই অনুপমাকে সবটা বলে জঙ্গলের একটা জায়গায় ফাঁদ পেতে বসলাম, তোরা সেখানে আসতেই শুনলাম সন্দীপও একই প্রসঙ্গে তোর সাথে কথা বলছে। আমিও তখন ঝটপট পকেট থেকে কাগজআর পেন বের করে মোবাইলের হাল্কা আলোয় চিঠিটা লিখতে শুরু করলাম। তোরা তো তখন আরেকটু হলেই পিছনফিরে আমাকে দেখেই ফেলছিলি।”

    অনুপম হাঁসতে লাগল সুনীলদার এই কথাটা শুনে। কিন্তু, সন্দীপ ঠিক স্বাভাবিক হতে পারছিল না। তাই মুখে কিছু না বলে এগিয়ে এসে সুনীলদার পেটে একটা ঘুসি মেরে জাপটে ধরলো তাকে।

“আমিও বা বাদ যাই কেন”, বলে অনুপমও এসে জাপটে ধরল। তখন অনুপমা লাফিয়ে ওদের পিঠে চড়তে গিয়ে চারজনই টাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে পড়ল খাটের ওপর। তারপর সশব্দে “হা: হা:” করে হাসতে শুরু করল ওরা।

    অনুপমা হঠাৎ বলল, “আচ্ছা সুনীলদা, কাল তুমি সারারাত ধরে কি লিখছিলে? সেই গল্পটা শেষ করলে বুঝি?”
“ঠিক ধরেছিস। গত রাতেই শেষ হল দু’বছর ধরে লেখা গল্পটা। সন্দীপ, আবার আমরা ‘বিষয়পত্র’কে রিভাইভ করব বুঝলি। আর প্রথম সংখ্যাতেই যাবে আমার লেখা এই গল্পটা।”
“তা নাম কি দিলে গল্পটার?”
“এখনও ঠিক করিনি রে। তবে গল্পের চরিত্রগুলো আর স্থান, কালের নাম-ধাম পাল্টাতে হয়েছে। কেননা গল্পে অন্য একটি পত্রিকার সম্পাদকের প্রতি একটু ভায়োলেন্স রয়েছে কিনা, তাই আসল নাম ব্যবহার করলে আমার কারাদন্ড নিশ্চিত।”
“আমি একটা নাম সাজেস্ট করবো?” মুচকি হেসে বলল সন্দীপ।

    অনুপমা তখন পাশের ঘর থেকে ম্যানুস্ক্রিপ্টটা নিয়ে এসে বলল, “বাহ রে, তুমি কিভাবে সাজেস্ট করবে! তুমি তো পড়োইনি গল্পটা।”
“আমাদের কি আর নতুন করে পড়ার দরকার আছে সুনীলদা?”

    সুনীল হেঁসে দু’পাশে মাথা নাড়ল। সন্দীপ ম্যানুস্ক্রিপ্টের ওপর বড় বড় অক্ষরে গল্পের নামটা লিখে দিল, ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’।

    তা দেখে অনুপম হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বলল, “থ্রি চিয়ার্স ফর ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’, হিপ হিপ হুররে!”

‘অক্টোবর ২০১৯, শারদীয়া সংখ্যা’ থেকে গৃহীত

Tagged with: