নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে – আজ তোরা যাস্ নে ঘরের বাইরে

ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

Posted On: August 26, 2021

নিম্নচাপের হাত ধরে ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে’। সঙ্গে রয়েছে করোনা তৃতীয় ওয়েভের ভ্রুকুটি। বর্ষা আর করোনার জোড়া আক্রমণের কথা ভেবেই যেন বাইরে যাওয়া মানা। রবীন্দ্রনাথও সেইসময় বর্ষার আগমনী সংবাদ জানিয়ে ইন্দিরাদেবীকে লিখেছিলেন: “কাল আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বর্ষার নব রাজ্যাভিষেক বেশ রীতিমত আড়ম্বরের সঙ্গে সম্পন্ন হয়ে গেছে। দিনের বেলাটা খুব গরম হয়ে বিকেলের দিকে ভারী ঘনঘটা মেঘ করে এল”। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, “মনে পড়ে, “বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান। ঐ ছড়াটা যেন শৈশবের মেঘদূত”। শান্তিনিকেতনে প্রথম বর্ষা উৎসব হয়, ১৯১৩ সালের জুলাই মাসের গোড়ার দিকে। সেই উৎসবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না। ক্ষিতিমোহন সেন লিখছেন: “মনে আছে একদিন বর্ষার সন্ধ্যা। কয়েকজন গুরুদেবের চারিদিক ঘিরিয়া বসিয়া আছি। গুরুদেব বলিলেন— “যদি আমরা প্রকৃতির প্রত্যেকটি ঋতুকে অন্তরের মধ্যে উপলব্ধি করিতে পারি তবেই আমাদের চিত্তের সব দৈন্য দূর হয়, অন্তরাত্মা ঐশ্বর্যময় হইয়া উঠে। আমরা মনে-মনে স্থির করিলাম এই বর্ষাতেই একটি বর্ষা-উৎসব করিতে হইবে।’ দিনুবাবু সদলবলে ‘অচ্ছা বদ তবসং গীর্ভিরাভিঃ’ এই বৈদিক বর্ষা সংগীতটি সুর সহ গান করিলেন। গুরুদেব দূর হইতেই এই সব খবর শুনিয়া খুব খুশি হইলেন”।

ব্রহ্মবিদ্যালয়ের ছাত্র হিমাংশুপ্রকাশ রায় লিখছেন: “সেকালে শান্তিনিকেতনের ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ছেলেরা যখন হৈ হৈ করে বেরিয়ে পড়ত, সময়-সময় স্বয়ং গুরুদেবও ঐ ঝড়বৃষ্টি, ঐ ভেজার খেলায় যোগ দিয়ে চলতেন নৃত্যে মত্ত হয়ে, কণ্ঠে গান নিয়ে— ‘আজ বারি ঝরে ঝরঝর’। 

রবীন্দ্রনাথ প্রথম বর্ষার গান লিখেছিলেন ষোলো বছর বয়সে ১৮৭৭ সালে “শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা” [ভারতীতে তার প্রথম পঙক্তিটি ছিল, “সজনী গো – আঁধার রজনী ঘোর ঘনঘটা”]।

সে গান যে জনপ্রিয় হয়েছিল তা বোঝা যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণ থেকে: “কোনো এক ব্রাহ্মণ জমিদার-সভ্যের [জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘শিকার’-এর দল] গঙ্গার ধারের একটি বাগানবাড়ীতে একবার আমাদের একটা প্রীতি-ভোজ হয়। খাওয়া-দাওয়া হইয়া গেলে খুব এক ঝড় উঠিল। রাজনারায়ণবাবু সেই সময় গঙ্গার ঘাটে দাঁড়াইয়া, চিৎকার করিয়া “আজি উন্মাদ পবনে…” [শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা] বলিয়া রবীন্দ্রনাথের নবরচিত একটি গান আরম্ভ করিয়া দিলেন”।

বর্ষার অনুষঙ্গযুক্ত দ্বিতীয় গানটি রচনা করলেন প্রায় পাঁচ বছর পরে, ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে, নাটকের প্রয়োজনে কালমৃগয়া-র “গহন ঘন ছাইল গগন ঘনাইয়া”। তারপর দীর্ঘ ১৩ বছর তাঁকে আর বর্ষার গান লিখতে দেখা গেল না।

১৮৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, তখন তাঁর বয়স পঁয়ত্রিশ চলছে, শিলাইদহে বসে রচনা করলেন বর্ষার তৃতীয় গানটি— “ঝরঝর বরিষে বারিধারা”।

ইন্দিরাদেবীকে [২০ সেপ্টেম্বর ১৮৯৫] লেখা একটি চিঠিতে এই গানটি নিয়ে মন্তব্য করেছেন রবীন্দ্রনাথ: “কাল পরশু দুদিন ঠিক আমার সেই নতুন গানের মতো দৃশ্যটা হয়েছিল—

ঝরঝর বরষে বারিধারা—
ফিরে বায়ু হাহাস্বরে জনহীন অসীম প্রান্তরে—
অধীর পদ্মা তরঙ্গ-আকুলা—
নিবিড় নীরদ গগনে—

ইত্যাদি। তার মধ্যে এই হতভাগ্য গৃহহারা ব্যক্তিটি স্টীমারের ছাতের উপরে আপাদমস্তক ভিজে একেবারে কাদা হয়ে গিয়েছিল। গায়ে সেই আমার মস্ত রেশমের আলখাল্লা পরা ছিল, সেটা ঝোড়ো বাতাসে চতুর্দিকে অত্যন্ত হাস্যকরভাবে উড়ে বেড়াতে লাগল”…

এর দেড়বছর পরে [২৯ এপ্রিল ১৮৯৭] জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বসে লিখলেন, “ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে”— কিন্তু গান হিসেবে নয় কবিতা হিসেবেই অর্থাৎ ‘বর্ষামঙ্গল’ কবিতা নামে। সুরযুক্ত হয়ে গানে পরিণত হতে লেগে গেল আরও ২৮ বছর।

বিংশ শতকে পৌঁছে একই দিনে তিনি দুটি কবিতা রচনা করলেন ২ জুন ১৯০০ তারিখে, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ‘আষাঢ়’ এবং ‘নববর্ষা’। পরবর্তীতে দেখা গেল কবিতাদুটি গানে রূপান্তরিত হয়েছে— যথাক্রমে “নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে” এবং “হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে”।

বর্ষা আবার গান হয়ে তাঁর মনে হানা দিল ১৯০৯ সালে। তার মধ্যে বর্ষার গান তৈরি হল ছ’টি, শিলাইদহ ও শান্তিনিকেতন মিলিয়ে: ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’, ‘আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল’, ‘আজি ঝড়ের রাতে’ ‘এসো হে এসো সজলঘন’ ইত্যাদি।

‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’— এই গানটি গাওয়ার স্মৃতিচারণ করে সীতাদেবী লিখছেন: “প্রবন্ধপাঠ শেষ হইতেই চারিদিক থেকে অনুরোধ আসিতে লাগিল একটি গানের জন্য। গান গাহিতে বলিলে আপত্তি তাঁহাকে তখনকার দিনে করিতে দেখিতাম না। রবীন্দ্রনাথ একটা ছোট খাতা বাহির করিয়া গান বাছিতে লাগিলেন। মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে – গানটি বোধহয় তখন সম্প্রতি রচনা করিয়াছিলেন, সেইটেই তিনি গাহিলেন”।

আজি ঝড়ের রাতে— গান সম্পর্কে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন: “রবীন্দ্রনাথের নিমন্ত্রণে একবার শিলাইদহে তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তখন তিনি কাছারীর পরপারের চরের গায়ে বজরা বেঁধে বাস করছিলেন। …রাত্রে আমাকে তার বোটে থাকতে অনুরোধ করলেন। …সন্ধ্যার সময় খুব ঝড়জল আরম্ভ হলো। কবি বললেন– “অজিত অতিথির সম্বর্ধনা করো, গান ধরো”। কবি গান ধরলেন, অজিত সঙ্গে যোগ দিলেন— “আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার পরাণসখা বন্ধু হে আমার”!…

“আজ বরষার রূপ হেরি” এই গানটি রচনার দিন একটি শোচনীয় ঘটনা ঘটে। ওইদিন ভোররাত্রে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের ছাত্র, রবীন্দ্রনাথের বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের পুত্র সরোজচন্দ্র (তার ডাকনাম ছিল ভোলা) অকস্মাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়। সরোজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কনিষ্টপুত্র শমীন্দ্রনাথের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল। এই মৃত্যুর বর্ণনা দিয়েছেন সরোজের সহপাঠী পরে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সুধীররঞ্জন দাস।

“তখন ম্যাট্রিকুলেশন ক্লাশের আমরা ক’জন লাইব্রেরি-বাড়ির (বর্তমান পাঠভবন দপ্তর) পশ্চিম দেওয়ালের লাগাও নতুন ঘরটিতে থাকতাম। একদিন জ্যোৎস্নায় আকাশ ভরে গিয়েছে – রাত্রে খাওয়া শেষ হলে সুহৃদ ও আমি, আর কে কে বেরিয়ে পড়েছি খেলার মাঠে। হঠাৎ নজরে পড়ল, আমাদেরই ঘরের সামনে কারা লন্ঠন নিয়ে ছুটোছুটি করছে। এসে দেখি ভোলা তার বিছানায় বেঁহুশ হয়ে পড়ে আছেন এবং গুরুদেব তাঁর পাশে একটা মোড়া না কিসের উপর স্তম্ভিত হয়ে বসে আছেন, নির্নিমেষ চোখে ভোলার দিকে তাকিয়ে। একটু পরেই বোলপুর থেকে হরিচরণ ডাক্তারবাবু এসে যখন বুক পিঠ ও নাড়ী পরীক্ষা করে মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, বুঝতে পারলাম যে আমাদের সতীর্থটিকে আমরা হারালাম”।

আমারে যদি জাগালে আজি নাথ,
ফিরো না তবে ফিরো না, করো করুণ আঁখিপাত॥
নিবিড় বনশাখার ‘পরে আষাঢ়মেঘে বৃষ্টি ঝরে,
বাদল-ভরা আলস-ভরে ঘুমায়ে আছে রাত॥

শঙ্খ ঘোষ [এ আমির আবরণ] লিখেছেন, প্রতিদিনের ছোটো-ছোটো গ্লানির মধ্যে ঘুরে বেড়াই, ক্লীব হয়ে আসে মন, নিজেকে ঘিরে-ঘিরে ঘুরবার ক্লান্তিতে ছেয়ে যাই, তখনই একবার আত্মকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে পড়বার ইচ্ছে হয় জগতের আনন্দযজ্ঞে। ভালেরি [ফরাসী কবি] তখন লিখতে পারেন “সেই হলো জাগরণ”, আর গীতাঞ্জলির কবি বলতে পারেন “আমারে যদি জাগালে আজি নাথ”। কিসের দিকে এই জেগে ওঠা? হয়ে-ওঠার মুক্তিতে”।

১৯২২ সালে অনুষ্ঠিত হল সেই বিখ্যাত বর্ষামঙ্গল— কলকাতায় টিকিট করে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রথম জলসা। এই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ নিজে গান গেয়েছিলেন। শান্তিনিকেতন পত্রিকায় লেখা হয়— “গুরুদেব একাকী যখন “আজ আকাশের মনের কথা ঝরঝর বাজে” গানটি গাহিতেছিলেন তখন বাহিরে শ্রাবণের ধারাও রাত্রির অন্ধকারে ঝরঝর ধারে ঝরিতেছিল। মানুষে প্রকৃতিতে মিলিয়া সেদিন যে সন্ধ্যাটির সৃষ্টি হইয়াছিল তাহা দুর্লভ সামগ্রী— জীবনে এমনতর সন্ধ্যা খুব বেশী আসে না”।

১৯২৫-এ উপস্থাপিত হল ‘শেষ বর্ষণ’। শান্তিনিকেতনে বর্ষামঙ্গল হল ৩ শ্রাবণ ১৩৩২ [১৯ জুলাই ১৯২৫] তারিখে, এবং এই অনুষ্ঠানে “ছায়া ঘনাইছে বনে বনে”, গানটি গেয়েছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে লিখেছেন, “[১৯৩৭ সালে] ‘ছায়া’ সিনেমা হলে বর্ষামঙ্গলের দিন গুরুদেব বসেছিলেন স্টেজের ওপরেই, চেয়ারে, একপাশে। আমি তাঁর হাতলের পাশটিতে দাঁড়িয়ে গাইছি, ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’। ভালই তো গাইছিলাম! কী জানি গুরুদেবের বোধহয় মনে হয়েছিল, আমি নার্ভাস। একসময় দেখি, উনিও আমার সঙ্গে গাইতে আরম্ভ করেছেন। সত্যি কথা যদি বলতে হয়, খুবই রাগ হয়েছিল আমার। কেন আমার সঙ্গে তিনি গাইলেন”?

“১৯৩১ সালে বর্ষামঙ্গল উপলক্ষ্যে ‘ক্ষণিকা’র ‘কৃষ্ণকলি’ কবিতাটিতে সুর দিলেন কীর্তন ও নানা রাগিণী মিশিয়ে”। প্রথমত রবীন্দ্রনাথের গানে দেশী বৈচিত্র্য ধ্রুপদী (ক্লাসিকাল) সুর বৈচিত্র্যের সঙ্গে এমনভাবে মিশেছে যা আগে শোনা যায়নি। বাঙালী, জৌনপুরী, সুরঠ, গুজ্জরী, পাহাড়ী প্রভৃতি প্রাচীন দেশী রাগসমূহের ধ্রুপদী সুরের সঙ্গে মিশ্রণ ঘটেছে একথা ঠিক। কিন্তু সেগুলি একেবারে মিশে এক হয়ে গেছে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ গানটি।

১৯৩৭ একটি দুর্ঘটনায় বর্ষামঙ্গল পিছিয়ে গেল। অধ্যাপক নিত্যানন্দবিনোদ গোস্বামীর একমাত্র পুত্র বীরেশ্বরের মৃত্যু ঘটায় অনুষ্ঠান স্থগিত হয়ে গেল। এই উৎসব পরে হল কলকাতায় মানিকতলার মোড়ে ‘ছায়া’ প্রেক্ষাগৃহে, ৪ ও ৫ সেপ্টেম্বর দু’দিন ধরে।

এই অনুষ্ঠানটির একটি চমৎকার স্মৃতিচারণ আছে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের— অনুষ্ঠানটি, তার রিহার্শাল, তার পর্দার আড়ালের নাটক, সব যেন মনশ্চক্ষে দেখতে পাওয়া যায়। “[১৯৩৭ সালে] গুরুদেব কলকাতার আর শান্তিনিকেতনের গানের দল মিলিয়ে ছায়া রঙ্গমঞ্চে বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠান করেছিলেন। হলটি খুব বড়, বলাই বাহুল্য মাইক্রোফোন ছিল না। স্টেজ রিহার্শালের সময় ধরা পড়ল যে একক কন্ঠের গানগুলি পেছন থেকে তেমন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। গুরুদেব বললেন, ‘হয় স্কেল চড়িয়ে দাও, নাহলে একক কন্ঠের গানগুলি যুগ্মকন্ঠে করতে হবে’। শেষ পর্যন্ত স্কেল চড়িয়ে গান হবে ঠিক হল।”

১৯৩৯ সালের বর্ষামঙ্গল হয় ২৭ অগস্ট— এই উপলক্ষে নতুন গান তৈরি হয় ষোলোটি। শৈলজারঞ্জন লিখেছেন কেমন করে গুরুদেবকে উত্তেজিত করে তিনি একের পর এক গান লিখিয়ে নিয়েছিলেন, তাঁর স্মৃতিকথায় তিনি বিবৃত করেছিলেন তার ইতিহাস। শৈলজারঞ্জন লিখছেন: “আমি উত্তরায়ণে গানের দল নিয়ে গিয়ে ছ’টি পুরনো গানের মহড়া গুরুদেবকে শোনালাম।
খেতে যাবার ঘন্টা পড়ল, ছেলেমেয়েরা খেতে চলে গেল। এই সুযোগে আমি গুরুদেবকে বললাম যে, ছেলেমেয়েরা বলছে নতুন গান চাই, পুরনো গানে আর ওরা বর্ষামঙ্গল করবে না।
গুরুদেব বললেন, এই অল্প সময়ের মধ্যে কী করে আর নতুন গান লেখা যায়? অন্য অনেক কাজও তো আছে।
সেদিন এই পর্যন্ত। পরদিন বেলা এগারোটায় গুরুদেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই নতুন লেখা একটি গান হাতে দিলেন। গানটি— ‘ওগো সাঁওতালি ছেলে।’
বর্ষামঙ্গলের জন্য দ্বিতীয় গান, ‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল’ পেলাম ‘ওগো সাঁওতালি ছেলে’ লেখার পরের দিনই। পাওয়ার পর আমার মনে হল, গুরুদেব তো বেহাগসিদ্ধ, বর্ষামঙ্গলের গান বেহাগ রাগিণীতে লিখতে অনুরোধ করলে কেমন হয়?
পরদিন ভোরবেলা বনমালীর সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি কাগজে ‘বেহাগ’ কথাটি লিখে গুরুদেবের লেখার টেবিলে চাপা দিয়ে রেখে চলে এলাম। সেটা চোখে পড়ামাত্রই বনমালীকে ডেকে বকতে আরম্ভ করলেন, তুই যাকে-তাকে এখানে আসতে দিস কেন? আমার অন্য কাজ বুঝি আর নেই? আমাকে কি ফরমাশি গান লিখতে হবে?
বনমালি চাপা হাসি হেসে চলে গেল। সেই বেহাগে পেলাম এই গান— ‘আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে’।
এর পরদিন আবার কাগজে লিখে এলাম ‘ইমন’, পেলামও— ‘এসো গো, জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি’ গানটি।
এবার আবার কাগজে লিখে রেখে দিয়ে এলাম, ‘তান দেওয়া গান’। পেয়ে গেলাম— ‘আজ শ্রাবণের গগনের গায়’।
সব সুদ্ধ হল পাঁচটি নতুন গান। ষষ্ঠ গানটি ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদল-দিনে’ গুরুদেব নিজে থেকেই লিখলেন।…”

রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ বর্ষার গান লিখেছিলেন: “এসো এসো ওগো শ্যামছায়াঘন দিন”। প্রভাতকুমারের গীতবিতানের কালানুক্রমিক সূচীতে রচনার তারিখ দেওয়া আছে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৪০— অর্থাৎ মৃত্যুর এগারো মাস আগে। গানটি সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু লিখছেন: “সেদিন বৃষ্টি নামলো, সন্ধ্যাবেলায় গিয়েছিলুম কবির কাছে। রথীবাবুর বড়ো বসবার ঘরটিতে দেখলুম রবীন্দ্রনাথের গানের অনেকগুলি রেকর্ড বাইরে পড়ে আছে— কবি খানিক আগে শুনছিলেন। তিনি ছিলেন ভিতরের দিকে ছোট ঘরটিতে, খুব ক্লান্ত ছিলেন সেদিন। আমরা যেতে বললেন, ‘একটা বর্ষার গান evoke করবার চেষ্টা করছিলুম— এখন আর হয় না’। শান্তিনিকেতনে বর্ষা এসে কবির অভিনন্দন পেলো না এমন ঘটনা এই প্রথম”।  

ঋণ: রবীন্দ্রজীবনকথা – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।
রবিজীবনী – প্রশান্ত কুমার পাল।
গানের পিছনে রবীন্দ্রনাথ – সমীর সেনগুপ্ত।
যাত্রপথের আনন্দগান – শৈলজারঞ্জন মুখোপাধ্যায়।

ফোটো: দ্য টেলিগ্রাফ অনলাইন

Tagged with: ,