মহাকাশ ভ্রমণ

সৌরদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted On: August 27, 2021

ছেলেবেলা থেকে কল্পবিজ্ঞান গল্পে মহাকাশ ভ্রমণের কথা আমরা অনেক পড়েছি। তখন একবারও ভাবিনি এই কল্পনা কখনও বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব। যেমন গ্রীষ্ম অথবা শীতের ছুটিতে আমরা পাহাড় অথবা জঙ্গল ভ্রমণে যাই, তেমনই হয়তো আগামীবছর থেকে ছুটি কাটাতে আমরা মহাকাশ ভ্রমণে যেতে চলেছি। কথাটা অনেকটা স্বপ্নের মতো হলেও একদম সত্যি।

এই স্বপ্নপূরণের নেপথ্যে তিনজনের নাম রয়েছে। প্রথমজন হলেন ভার্জিন গ্রুপ অফ কোম্পানির কর্ণধার রিচার্ড ব্র্যানসন, আরেকজন অ্যামাজন-এর মালিক জেফ বেজোস এবং তৃতীয়জন টেসলা-র মালিক এলোন মাস্ক। ‘ফোর্বস’-এর একটি খবর থেকে জানা যায়, গত কয়েকমাস ধরে রিচার্ড ব্র্যানসন আর জেফ বেজোসের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা চলে, নিজস্ব মহাকাশযানে চড়ে কে প্রথম মহাকাশযাত্রী হবে সেই নিয়ে। অবশেষে রিচার্ড ব্র্যানসন এই প্রতিযোগীতায় জয়ী হন, এবং গত ১১ জুলাই দু’জন পাইলট আর তিনজন সদস্যসহ এই যাত্রা সফলভাবে সম্পন্ন করেন। ওঁর স্পেস ট্যুরিজম কোম্পানির নাম হল ‘ভার্জিন গ্যালাক্টিক’। মজার ব্যাপার, ব্র্যানসনের এই ‘ইউনিটি’ স্পেশক্রাফ্টটি কোনও রকেট ছিল না। বরং অনেকটা এরোপ্লেনের মতোই ছিল। রানওয়েতে আরও দুটো প্লেনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে ‘ইউনিটি’ স্পেসক্রাফ্ট টেক-অফ করে। তারপর প্রায় পঞ্চাশ হাজার ফুট উচ্চতায় পৌঁছে দু’টো প্লেনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্পেসক্রাফ্টটি শব্দের থেকেও দ্রুত গতিতে মহাকাশের দিকে এগিয়ে যায়। এভাবেই পনেরোমিনিট পর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৮ কিলোমিটার উচ্চতায় পৌঁছে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কমে যায় এবং ভারশূন্যতার অনুভূতি শুরু হয়। তবে এই অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র চার মিনিটের জন্যই স্থায়ী হয় এবং স্পেসক্রাফ্টটি আবার সাধারণ এরোপ্লেনের মতোই রানওয়েতে নেমে আসে। এই মহাকাশ ভ্রমণের সম্পূর্ণ তথ্য ব্র্যানসনের লাইভ স্ট্রিমিং থেকে জানা যায়। আরও একটি আনন্দের খবর জানা যায় যে এই দলে শিরিসা বান্ডলা নামক একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহিলাও ছিলেন। কাজেই সবমিলিয়ে এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা তো বটেই।

অবিশ্যি রিচার্ড ব্র্যানসনের এই মহাকাশ ভ্রমণ নিয়ে বেশ কিছু বিতর্কও শুরু হয়। প্রথমত ‘ইউনিটি’ স্পেসক্রাফ্ট থেকে নাইট্রাস অক্সাইড নির্গত হয়েছিল,  যা পরিবেশের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এছাড়াও জেফ বেজোসের স্পেস ট্যুরিজম কোম্পানি ‘ব্লু-অরিজিন’, তার অফিসিয়াল ট্যুইটার পেজ থেকে পোস্ট করে যে, ব্র্যাইসনের ‘ইউনিটি’ স্পেশক্রাফ্ট শুধুমাত্র ৮৮ কিমি পর্যন্তই গিয়েছিল। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতে সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১০০ কিমি উচ্চতা অতিক্রম করার পরেই মহাকাশের সীমানা শুরু হয়। এই সীমারেখাকে ‘কারমান লাইন’ বলা হয়। কাজেই ব্র্যাইসন মহাকাশে পাড়ি দেননি। আবার ‘নাসা’-র মতে ৮০ কিমি উচ্চতা পেরোলেই মহাকাশের সীমানা অতিক্রম করা যায়। এভাবে এই মহাকাশ ভ্রমণ নিয়ে আমেরিকা এবং পৃথিবীব্যাপী অন্যান্য মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ শুরু হয়। এই মতবিরোধ চলাকালীন জেফ বেজোস প্রস্তুতি শুরু করেন তার মহাকাশযাত্রার, আর গত ২০ জুলাই তিনিও সফলভাবে মহাকাশ ভ্রমণ সেরে আসেন। ওঁর ‘ব্লু-অরিজিন’ কোম্পানির মহাকাশযানটি তথাকথিত রকেটের মতোই। লঞ্চপ্যাড থেকে উৎক্ষেপিত হয়ে মাত্র দশ মিনিটের মধ্যেই ১০০ কিমি উচ্চতায় পৌঁছে কারমান লাইন অতিক্রম করে। তারপর সেই ক্যাপসুলটি প্যারাস্যুটের মাধ্যমে মাটিতে নেমে আসে। এই যাত্রার সব থেকে আকর্ষণীয় বিষয় হল ক্যাপসুলের জানলাগুলি ছিল বেশ বড়, কাজেই মহাকাশ থেকে পৃথিবীর দৃশ্য দেখতে অসুবিধে হয়নি। এছাড়াও রকেটটি ছিল সম্পূর্ণ অটোমেটিক, কোনও পাইলট ছিল না। জেফ বেজোস শুধুমাত্র তিনজন যাত্রীসহ এই মহাকাশ ভ্রমণে গিয়েছিলেন।

এবার আসি সাধারণ মানুষের মহাকাশ ভ্রমণের কথায়। জেফ বেজোসের ‘ব্লু-অরিজিন’ আর এলোন মাস্কের ‘স্পেস এক্স’ কোম্পানি এখনো পর্যন্ত মহাকাশ ভ্রমণের কোনও টিকিটমূল্য ধার্য করেননি। তবে ‘বিজনেস ইনসাইডার’ থেকে জানা যায় রিচার্ড ব্র্যাইসনের ‘ভার্জিন গ্যালেক্টিক’ কোম্পানির মহাকাশযানে চড়তে একটি টিকিটের মূল্য দিতে হবে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। ইতিমধ্যেই আগামী বছরের জন্য প্রায় ৬০০ জন বুকিং করে ফেলেছেন। যার মধ্যে রয়েছেন জাস্টিন বাইবার, লিওনার্দো ডি ক্যাপরিও-র মতো তারকারা। তবে মধ্যবিত্ত মানুষদের পক্ষে কি এই যাত্রা সম্ভব? এই সময়ে দাঁড়িয়ে একদমই নয়। অবিশ্যি ব্র্যানসনের মতে আগামী কয়েকবছর পরে টিকিটমূল্য নিশ্চয়ই কমে যাবে। তখন না হয় আমরাও মহাকাশ ভ্রমণ সেরে আরেকটি প্রবন্ধ বিচিত্রপত্র-র ওয়েবসাইটে লিখতে পারব। আপাতত এটুকুই লিখতে পারি এই টিকিটমূল্য দিয়ে কেবল ভ্রমণই নয়, ভ্রমণ-পূর্ববর্তী বেসিক ট্রেনিংও দেওয়া হবে। কেন না জিরো গ্র্যাভিটিতে বিচরণ করা চাট্টিখানি কথা নয়। এছাড়াও ভ্রমণ-পরবর্তী নানান শারিরীক সমস্যাও হতে পারে। এই সমস্ত দিক বিবেচনা করেই মহাকাশ ভ্রমণে যেতে হবে।

আরও একটি দিক বিবেচনা করা দরকার। আগামীবছর থেকে নিয়মিত মহাকাশ ভ্রমণ শুরু হলে সেই মহাকাশযান থেকে নির্গত গ্যাসের প্রভাব পড়বে ওজোন স্তরের ওপর, কাজেই নষ্ট হবে প্রকৃতির ভারসাম্য। বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের জীবনে ঠিক যতটা দরকারী, ঠিক ততটাই দরকার পরিবেশ সচেতনতা। কাজেই বিজ্ঞান ও প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় থাকলেই এই মহাকাশ ভ্রমণ সুখকর হবে এবং আমরাও ভবিষ্যতে কল্পবিজ্ঞান গল্পের একেকটি চরিত্র হয়ে উঠতে পারব।

তথ্যসূত্র :-
BBC News, Hindustan Times, Dhruv Rathee, NDTV, Insider News, Vergin Galectic,  ABC News, National Geographic, The Tesla Space.

ফোটো: ভার্জিন গ্যালেক্টিক, ব্লু অরিজিন

Tagged with: ,