পাঠকের দরবারে আপনার মতামত

বাণীব্রত গোস্বামী

Posted On: January 13, 2022

গঙ্গাপ্রাপ্তি

খুব সুন্দর বিষয়। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তবে প্রথমেই যখন এই বিজ্ঞাপনটি চোখে পড়ল, তখন বিশ্বকবির একটি লাইনই ঘুরেফিরে মাথায় আসতে লাগল, ‘চল্ তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে’। এ-কথা ভাববার যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। কারণ, আমি নিজে বেশ কয়েকবার গঙ্গাসাগর গেছি এবং মকরসংক্রান্তির মেলাতেই গেছি। কিছু লেখালেখির কাজ নিয়ে। যদিও প্রবাদ আছে ‘সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার’। সেটা আমার ক্ষেত্রে খাটেনি, তবে এইটুকু বেশ জোর দিয়ে বলতে পারি, যে এবারে যারা সব কিছু উপেক্ষা করে যাবে, তাদের ক্ষেত্রে এই প্রবাদটি মোক্ষম প্রযোজ্য হবে। যেহেতু অনেকেই আর এই ধরাধামেই বিরাজ করবেন না হয়ত।

এবার আসি বাস্তব পরিস্থিতিতে। কোনমতেই যে এবছর গঙ্গাসাগর মেলা করা উচিত নয়, তার মূলতঃ তিনটি কারণ—

প্রথমত, গঙ্গাসাগরে যে পরিমাণ জনসমাগম হয়, তার তুলনায় কপিলমুনির মন্দির ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল যথেষ্টই অপ্রতুল। মন্দির নিকটবর্তী সমুদ্র-সৈকত সংকীর্ণ ও খুবই অপরিচ্ছন্ন। স্নান আর প্রাতঃকৃত্য মোটামুটি পাশাপাশিই চলে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে সরকারি সামাজিক দূরত্ববিধি বা অন্যান্য করোনা বিধিনিষেধ কতটা অনুসরণ করা যাবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যার ফল হতে পারে মারাত্মক। জ্যামিতিক অগ্ৰগতিতে বাড়তে থাকবে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। সেই পরিমাণ চিকিৎসাব্যবস্থা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা সারা ভারতবর্ষে নেই। ভেঙে পড়বে স্বাস্থব্যবস্থা। দিকে-দিকে দেখা যাবে মৃত্যুমিছিল।

দ্বিতীয়ত, সাহস নিয়ে একটা কথা বলতেই হচ্ছে, যে গঙ্গাসাগরের ভিড়ের বেশীরভাগই ভিন্ রাজ্য থেকে আসা মানুষজন। আমি দেখেছি, তাদের মধ্যে প্রকৃত শিক্ষা আর সচেতনতা, দু’টোরই বড় অভাব। যেটুকু আছে, শুধু ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কার। ফলে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বহু গুণ বেড়ে যাবে। তারা গভীরভাবে বিশ্বাস করে, মাস্ক, স্যানিটাইজার মূল্যহীন। অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। গঙ্গাসাগরে ডুব দিলে, সবকিছু থেকে মুক্তি।

তৃতীয়ত, যেটা সবচেয়ে মারাত্মক— ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোক আসে গঙ্গাসাগরে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় কেন্দ্র বা রাজ্যের উদ্যোগে এতদিন পর্যন্ত কোন সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ, এত জগদ্বিখ্যাত তীর্থস্থান হওয়া সত্ত্বেও গঙ্গাসাগর গন্তব্য অবধি হল না। এর ফলে প্রতিবছর এই মকরসংক্রান্তির সময় শিয়ালদহ স্টেশন বিগ্ৰেড সমাবেশের চেহারা নেয়। সারা ভারতবর্ষের নানা জায়গা থেকে সবাই আগে কোলকাতায় আসে। তারপর একটিই রাস্তা। নামখানা লোকাল। যেখানে ভিড়ে সবাই চিঁড়ে চ্যাপ্টা। আর একটি উপায় অবশ্য আছে, তা হল বাসপথ। ভিড় সেখানে বাদুড়ঝোলা। তাহলে নিট্ ফল কী দাঁড়াল! গঙ্গাসাগর মেলা তার ক্ষতির পরিধি শুধু গঙ্গাসাগর দ্বীপে সীমাবদ্ধ রাখবে না, তিলোত্তমার বুকেও সেই সংক্রমণের ঢেউ মাখাতে সময় নেবে না।

তবে চিন্তাভাবনা শুধু একমুখী রাখলে চলবে না। কারণ এই গঙ্গাসাগর মেলার ওপর নির্ভর করে ঐ দ্বীপের আর্থসামাজিক পরিকাঠামো। যারা মেলায় দোকান দেয়, শুধু তারা নয়, প্রতিটি গাড়িওয়ালা, টোটো, অটো, রিক্সাওয়ালা থেকে আরম্ভ করে, ছোট-ছোট খাওয়ার হোটেল, বড় সব থাকার হোটেল সবাই তাকিয়ে থাকে, ঐ দিনগুলোর দিকে। একটা সামান্য লজেন্স বা বেলুনওয়ালাও আঙুলে গুনতে থাকে, মেলার আর ক’দিন বাকি! সৎ-অসৎ, সাধু-অসাধু সবারই চরম ক্ষতি হবে মেলা বন্ধ হলে।

তবে সব ব্যাপারে প্রশাসনকে শুধু দায়ী করলে হবে না। কারণ প্রশাসন দাঁড়িয়ে আছে ভোটবাক্সের পুঁজির জোরে। তাই রাজ্য, কেন্দ্র উভয় প্রশাসনই ভয় পায় ধর্মে আঘাত হানতে। সবাই নিরাপদ খেলতে চায়। তাই সবার আগে জনগণকে করে তুলতে হবে প্রকৃত শিক্ষিত ও সচেতন। আমি দেখেছি গঙ্গাসাগরযাত্রীর শতকরা নব্বই শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করে, মকরসংক্রান্তির দিনে সূর্যোদয়ের সময় গঙ্গা আর বঙ্গোপসাগরের এই সঙ্গমে স্নান করলে নাকি সর্ব রোগমুক্তি হয়! এই ধারণা থেকে মানুষকে বার করে আনতে হবে। বোঝাতে হবে পুণ্যের আগে প্রাণ। প্রাণ থাকলে আবার পুণ্যার্জন করা যাবে।‌ দলমত নির্বিশেষে অরাজনৈতিকভাবে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে। আমরা যদি এখনও অপেক্ষা করি যে, বেড়ালের গলায় ঘন্টি কে পরাবে? তাহলে আগামীতে সমূহ বিপদ। তখন কিন্তু আল্লা, ভগবান, গড্ তিনজনে মিলে একসাথেও আমাদের বাঁচাতে পারবে না। বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে লক্ষাধিক মানুষ। অতিমারী রূপ নেবে মহামারীতে।

তাই অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা,পর্যটন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কথা মাথায় রেখেও, এই বছর গঙ্গাসাগর মেলা না হওয়ার দিকেই আমার মতামত থাকল। তবে সাধারণ, সুস্থ, বুদ্ধিজীবীসম্পন্ন সুশিক্ষিত মানুষের এই আবেদন কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা মা গঙ্গাই জানেন। আপাত ক্ষতির চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে, ঐ অঞ্চলের মানুষকে প্রাণের তাগিদে রাজনীতির ছাতার তলা থেকে বেরিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তা যদি না পারে, হয়তো ঐ দ্বীপের সিংহভাগ মানুষ গঙ্গাসাগর মেলার দু’পয়সা আমদানি দেখতে গিয়ে, নিজেরাই গঙ্গাপ্রাপ্তির দিকে এগিয়ে যাবে।

ফোটো- ইন্টারনেট

Tagged with: ,