অর্থের অর্থ

বাণীব্রত গোস্বামী

Posted On: December 12, 2021

ঋষিকেশ নামতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল। গঙ্গোত্রী থেকে টানা দশ ঘন্টার রাস্তা। বাসস্ট্যান্ডের পাশেই একটা সুলভ শৌচালয় আছে। বাস থেকে নেমে অনেকেই আমার মতো ওদিকেই হাঁটা দিল। সেখান থেকে বেরনোর ঠিক মুখে, সিঁড়ির খাঁজে একটা দু’হাজার টাকার নোট পড়ে আছে। ক্ষণিকের জন্য মনটা দ্বিধাগ্রস্ত হল, তারপর চট করে মনস্থির করে দু’পায়ের ফাঁক থেকে টাকাটা পকেটে তুলে নিলাম। দ্রুত হেঁটে গিয়ে হোটেল হিমাচলে উঠে পড়লাম।
২০১৯, অক্টোবরের শেষ। ঠান্ডা না পড়লেও গরম একেবারেই নেই। কিন্তু তবুও আমার কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। নিজের মনকেই নিজে বোঝাচ্ছি, আমি তো চুরি করিনি। এ টাকাটা কার আমি জানি না, তাহলে ফেরৎ দেব কী করে? আমি না নিলে তো অন্য কেউ নিয়ে নিত। আবার কখনও মনে হচ্ছে, কোন আশ্রমে দান করে দেব, বা কোন গরীবকে দিয়ে দেব। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হোটেলের ঘরে ঢুকে পকেট থেকে টাকাটা বের করলাম। টাকার নম্বরটা দেখে ধপ্ করে খাটে বসে পড়লাম। 34 B 280785। আমার বয়স ও জন্মতারিখ। বিদেশ বিভুঁই। একদম একা। কারোর সঙ্গে কথাটা শেয়ারও করতে পারছি না। একটু নার্ভাস লাগছে। যাই হোক, নিজেকে সামলে নিয়ে ঋষিকেশ স্টেশনে গেলাম। উদ্দেশ্য ফেরার টিকিট কাটা। কিন্তু আগামী সাতদিন ফেরার কোন টিকিট নেই। হাতে কিছু বাড়তি টাকাও এসে গেছে। লক্ষ্ণৌ’র একটা টিকিট কেটে নিলাম। হঠাৎ মনে পড়ল সুলভে কুড়ি টাকার নোট দিয়েছিলাম।পনেরো টাকা ফেরৎ নিতে ভুলে গেছি। যাকগে, তা হলে সর্বসাকুল্যে লাভ হল ঐ ১৯৮৫ টাকা। আমার জন্মসাল। সংখ্যাগুলো অদ্ভুতভাবে জীবনের সাথে মিলে যাচ্ছে। নানারকম ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম। কালকে আবার ট্রেন।

।।২।।

লক্ষ্ণৌ স্টেশনে এসে নামলাম। এই শহরে অনেকদিন পর এলাম। এখান থেকে কোলকাতার অনেক ট্রেন। একদিন শহরটায় থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। ইচ্ছের কারণ, ওই বাড়তি ক’টা টাকা। টাকা আমার পকেটে থাকতে চায় না। আর টাকা শেষ না হলে, বাড়িও আসতে ইচ্ছে করে না। স্টেশন থেকে শহরে নেমে মনে পড়ল, ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু অভিজ্ঞান তো লক্ষ্ণৌতেই থাকে। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। অনেকদিন কোন খোঁজখবর নেই। দোষ অবশ্য আমারই। কারও সাথে কোনও যোগাযোগ রাখি না আজকাল। আর কী-ই বা রাখব! চাল নেই, চুলো নেই। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াই। শখের মধ্যে একটু লেখালেখি করি। ভালো-মন্দ মিশিয়ে চাকরি অনেকগুলোই করেছি। কিন্তু মন বসেনি। আর চাকরিরই বা দোষ কী! এত ছুটি একশো দিনের কাজেও বোধহয় পাওয়া যায় না। অনেক কষ্টে মনে পড়ল, অভিজ্ঞান থাকে আয়েশবাগে। তাছাড়া, না আছে ঠিকানা, না আছে ফোন নাম্বার। তবুও একটা টাঙ্গা নিয়ে আয়েশবাগ গেলাম। জায়গাটা জমজমাট। বেশ বড় বড় কয়েকটা বিরিয়ানীর দোকান। অভিজ্ঞানের মুখটা মনে করার চেষ্টা করছি। মনে পড়ল, ক্লাস টেন থেকেই খুব সিগারেট খেত। সামনেই চোখে পড়ল একটা সিগারেটের দোকান। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। একটা সিগারেট কিনে, অভিজ্ঞানের চেহারার বর্ণনা দিলাম। এক ঝটকায় অন্ধকারে ঢিলটা লেগে গেল। দোকানদার বলল, “দু’টো গলি বাদ দিয়ে ডানদিকে ঢুকে গিয়ে চার নম্বর বাড়ির নীচে এক বাঙ্গালী ইঞ্জিনিয়ারবাবু থাকেন।”
দোটানা নিয়ে এগিয়ে গেলাম সেদিকেই। দরজায় বেল বাজাতেই একটা বাচ্ছাছেলে বেরিয়ে এল। জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কি অভিজ্ঞান বোসের বাড়ি?”
ছেলেটি ‘মা’ বলে ডেকে উঠল। ভেতর থেকে এক সুন্দরী মহিলা বেরিয়ে এলেন। বোধহয় অভিজ্ঞানের স্ত্রী। উনি প্রশ্ন করলেন, “হ্যাঁ, এটা অভিজ্ঞানবাবুর বাড়ি; আপনি?”
“আপনি আমাকে চিনবেন না, আমি ওর ছোটবেলার বন্ধু।”
“ঠিক আছে, বসুন। ওর আসতে রাত হয়ে যায়।”
“আচ্ছা তাহলে আমি একটু ঘুরে আসি বরং।”
“না না, আপনি অপেক্ষা করতে পারেন এখানেই।”
আমি বেরিয়ে এলাম, বুঝলাম মুখে না বললেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ভদ্রমহিলা। সেটাই স্বাভাবিক। আমি তো অজানা, অপরিচিত।
হোটেলে উঠলাম না।একটু রাত করেই আবার গেলাম অভিজ্ঞানের বাড়ি। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবছি, অভিজ্ঞান কি ফিরেছে? হঠাৎ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল এক কোট-প্যান্ট পরা আপাদমস্তক সাহেবী কায়দার লোক। বলে উঠল, “তুই ব্যাটা এখানে কী করছিস?”
চিনতে পারিনি অভিজ্ঞানকে। সত্যিই চেনার মতো সে নেই আর। বড় চাকরির ছাপ চেহারায়। অনেক পরিবর্তন।
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “সে অনেক কথা,পরে বলছি।”
“শোন, আগেই বলছি, এতদিন পরে দ্যাখা, চট করে ছাড়ছি না।”
“ঠিক আছে, সে হবে খন।”
ভেতরে গিয়ে বসলাম। গল্প আর শেষ হচ্ছে না। কথায়-কথায় সে জিজ্ঞেস করল, “তুই এখন কী করছিস?”
সত্যি কথাই বললাম, “একটা প্রকাশনা সংস্থা দু’মাস আগে, তিন মাসের মাইনে দিয়ে ছাড়িয়ে দিয়েছে। তবে দোষ ওদের নয়। দোষটা আমারই। এখন বেকার।”
“তুই এত প্রকাশকের কাছে কাজ করেছিস, প্রুফ দেখতে পারিস, বইয়ের অনেক কিছু বুঝিস, লেখালেখি করিস, তোর কাজের অভাব?”
“কাজের তো অভাব নেই। অভাব আমার ধৈর্য আর একাগ্ৰতার। আর আছে অর্থের অভাব,” বলে কুড়িয়ে পাওয়া টাকার গল্পটা ওকে বললাম। সঙ্গে এটাও বললাম যে, ওই টাকাটা পেয়েছিলাম বলেই ওর সাথে আজ আমার দেখা। ও জানাল, ওর এক শ্যালক হিন্দোল, কোলকাতায় নাম করা ‘বর্ণমালা’ প্রকাশনীর কর্ণধার। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তবে শর্ত একটাই— মন দিয়ে কাজটা করতে হবে। যেটা আমার কাছে সবচেয়ে কঠিন। দু’দিন বেশ আনন্দেই কাটল।

।।৩।।

কোলকাতায় ফিরে অভিজ্ঞানের সুপারিশে চাকরিটা হয়ে গেল। ওর সম্মান রাখতে মন দিয়েই কাজটা করতে লাগলাম। নতুন, পুরোনো, উঠতি, বিখ্যাত অনেক লেখক-লেখিকা আসেন সেখানে। অনেকের সাথেই আলাপ হল। আর আসে এক নামী স্কুলের বাংলার শিক্ষিকা। বয়স বছর তিরিশ। সাদা খামে ভরা ‘লেখা’ নিয়ে। জলছবির মতো নাম, ঠিকানা তাতে। নাম বলাকা মিত্র। সুন্দর আমি অনেক দেখেছি। পাহাড়ের গায়ে বরফের মুকুটে সাত রঙের খেলা দেখেছি। চাঁদের আলোয় দিগন্ত বিস্তৃত রূপোর রাজত্ব দেখেছি। ফুলের উপত্যকায় ঈশ্বরের দোলযাত্রা দেখেছি। আবার কখনও কোন পাগল পীতাভ নদীকে হঠাৎ স্নিগ্ধ, শান্ত হয়ে জমে যেতে দেখেছি। তাই সৌন্দর্য আমায় টলাতে পারবে না। কিন্তু, বলাকার মধ্যে একটা অন্য জিনিস আছে— ওর গভীরতা। যেখানে কোনও দিগভ্রান্ত নৌকা একবার নোঙর ফেললে আর ভাসতে পারবে না। আর সেই যাবতীয় গভীরতা ওর চোখে। ওর চোখের তারায় সত্যিই নক্ষত্রের মত একটা নিজস্ব আলো আছে। যেটা অনেক আলোকবর্ষ দূর থেকেও আমাকে ধীরে ধীরে আলোকিত করতে লাগল। যখনই আসে দু-চার কথা হয়। উদ্দাম প্রেমের বয়স আর নেই। কিন্তু একটা চোরাস্রোত বইতে লাগল। একদিন হঠাৎ প্রশ্ন করল, “আপনার বাড়িতে আর কে আছে?”
আমি সাহস করে বলে দিলাম, “এই মুহূর্তে ‘আপনার’ বলতে শুধু আপনি। বাড়িতে আর কেউ নেই।”
যাওয়া-আসাটা বাড়তে লাগল। এই বয়সে প্রেম একটা অভ্যাসের মতো। তবুও ভালোবাসা ঘনীভূত হতে লাগল। কাপড়ের রঙে, ঠোঁটের লিপস্টিকে বলাকার ইদানীং প্রেমের ছোঁয়া। রঙগুলো একটু গাঢ় হয়েছে। তবে মুখে এখনও কিছু প্রকাশ করেনি। আমিই একদিন সাহস করে বললাম, “সন্ধের পরে কী করেন?”
“টুকটাক লেখালেখি আর গল্পের বই পড়ি।”
“আজ কি খুব ব্যস্ত?”
“এই বয়সে এত ঘুরিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। কোথায় যাবেন বলুন?”
প্রায় ছ’মাস হল বলাকার সঙ্গে আলাপ। তারপরেও আমার বাকভঙ্গিমা দেখে নিজেই বুঝতে পারলাম পুরুষমানুষ হিসাবে কেন আমি ব্যর্থ! মেয়েদের মন বোঝার ন্যূনতম যোগ্যতা আমার নেই। আর তার থেকেই আত্মবিশ্বাসের অভাব। তাই লজ্জা পেয়েই বললাম, “কোথাও একটু বসে গল্প করলে হত। আসলে বাড়ি ফিরলে তো সেই একা।”
“কফিহাউসে যাবেন?”
“হ্যাঁ যাওয়া যায়।”
মোটামুটি গত পনেরোবছর ধরে এই কফিহাউসে কত ছেলেমেয়েকে প্রেম করতে দেখেছি। জানি না, তাদের বিয়ে হয়েছে কিনা। তবে আমি যে কোনদিন একটা প্রেমভাব নিয়ে কোন মহিলার সাথে এখানে আসব তা স্বপ্নেও ভাবিনি। আজ একটু বোকা লাগছে নিজেকে। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছি, যারা প্রেম করে তারা চালাক আর যারা প্রেমে পড়ে তারা বোকা।
এরপর আমরা প্রায়ই এদিক-ওদিক বেড়াতে যেতাম। পরস্পরের অনেক কাছাকাছি আসতে থাকলাম। পরিণত বয়সের প্রেমে শরীরের আগে মন চলে। মন দিয়ে দু’জনে দু’জনকে বুঝতে চাইলাম। দেখলাম খাপ খাচ্ছে। বুঝলাম, দু’জন একাকী মানুষের দু’জনকে প্রয়োজন। অনেক দেরিতে হলেও বুঝলাম, একজন নারী আর পুরুষ মিলেই একটা পরিপূর্ণ জীবন। তারা পরস্পরের পরিপূরক।
এখন আমরা ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’-তে নেমে এসেছি। আজ আমরা এসেছি প্রিন্সেপ ঘাটে। সূর্য তখনও ডোবেনি। কোণে দেখা আলো আকাশ থেকে জলে গুলে যাচ্ছে। নৌকাগুলো আস্তে আস্তে কালো হয়ে যাচ্ছে। কচুরিপানার দলগুলো এক হচ্ছে। পাখিরা নিজের সঙ্গী খুঁজে নিয়ে একে একে ঘরে ফিরে আসছে। আজ আমার হাতে হাত দিয়ে বসেছে বলাকা। এখন আমি অনেক সাহসী। আমার নৌকায় পাল তুলে দিয়েছে বলাকা। আমার জীবনের এখন ‘দিক’ আছে, ‘ইচ্ছে’ আছে। বুকের মধ্যে বাঁচার আশা আছে, লক্ষ্য আছে। ওর চোখ দু’টো এই সাহস ভরে দিয়েছে মনে। আস্তে করে বললাম, “আমার আর একা বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না।”
“কারোরই করে না। সব কি মুখে বলতে হয়?”
“আমি তোমায় নিয়ে সামাজিক অধিকারে বাঁচতে চাই।”
“খাঁচায় ঢুকতে চাইছো, পরে খাঁচা থেকে পালাতে ইচ্ছে করবে না তো?”
“যদি উড়তে ইচ্ছে করে, তোমায় নিয়ে উড়ব।”
“আমার ডানা যদি ভারি হয়ে যায়?”
“তোমার সাথে কথায় পারব না। আমি কিন্তু সব ঠিকঠাক করছি। আমাদের তো কেউ নেই, নিজেদেরই সব করতে হবে।”
“যা ভালো বোঝ, করো।”
এই প্রথম বলাকাকে এত অল্পবয়সী মনে হল। কিশোরীর মতো হেসে উঠল সে। আমি ঘাড়ের কাছে আলতো হাত দিয়ে বললাম, “বিয়ের পরে কোথায় যাবে? পাহাড় না সমুদ্র?”
“যেখানে নিয়ে যাবে।”
“আমার ইচ্ছে, মুসৌরি।”
“না… গত বছরই তো পুজোর পর স্কুলের কয়েকজন কলিগ মিলে ঘুরে এলাম। এখনও আমার মনে পড়লে আফসোস হয়।”
“কিসের আফসোস?”
“আরে… ঋষিকেশে সন্ধেবেলা একটা সুলভ শৌচালয়ে পয়সা দিতে গিয়ে একটা দু’হাজার টাকার নোট পড়ে গেল। খানিকক্ষণ পরে দৌড়ে গেলাম। ও আর পাওয়া যায়! যে নিয়েছে, সে কি আর দেবে?”
আমি চুপ। আমার শরীর মার্বেলের বেঞ্চের থেকেও ঠান্ডা। শুধু ভাবছি এই যে সামনের বয়ে চলা জল, সে তো ক’দিন আগে ঋষিকেশে ছিল, আবার কত কিছুর সাক্ষী হয়ে আজ আমার সামনে দিয়ে বিশাল সমুদ্রে হারিয়ে যাবে। যেমন আমি মিশে যাব আর পাঁচজনের মতো জনসমুদ্রে। শুধু টাকার ওপর গান্ধীজির হাসিটা আমার কেমন অদ্ভুত লাগে! মনে হয়, যেন আমাকে কিছু বলতে চান।

Tagged with: , ,