সন্তুর ঠাকুমা

অমিতাভ ভট্টাচার্য্য

Posted On: August 29, 2021

সকালবেলা ঘুম ভেঙে উঠে সন্তু জানতে পারল তার ঠাকুরদা মারা গিয়েছে। পিসি ঘরের দরজার সামনে বসে কপাল চাপড়াচ্ছে আর সুর করে বলছে, “আমাকে অনাথ করে রেখে গেলে বাবা।”  সন্তু ‘অনাথ’ শব্দটার মানে জানে না। তাই ভালো করে বুঝতে পারছে না ঠিক কি ঘটেছে তাদের বাড়িতে; দাদুই-বা কোথায় চলে গেছেন। পাশের বাড়ির রুম্পিদিদির মা, পিসির পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দাদুর ঘরের ভেতরে ভিড় কেন? কি হচ্ছে? সন্তু পিসির পাশ দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। দাদু খাটের ওপরে শুয়ে আছে। চোখ দু’টো বোজা, দু’টো চোখের পাতার ওপরে একটা করে তুলসীপাতা রয়েছে; নাকে তুলো গোঁজা। একটা সাদা চাদর দিয়ে শরীরটা ঢাকা। ঠাম্মা খাটের ওপরে দাদুর পায়ের কাছে বসে স্থির দৃষ্টিতে দাদুর দিকে তাকিয়ে আছে। পিসিঠাম্মা মেঝের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে। সন্তু ওর বাবাকে ঘরের মধ্যে দেখতে পেল। দিদিকেও দেখতে পেল পিসিঠাম্মার পাশে বসে আছে। সন্তু চুপচাপ দিদির পাশে গিয়ে বসে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে দিদিকে কানে-কানে জিজ্ঞাসা করল, “এই দিদি, অনাথ মানে কী রে?” 

বাইরে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। বীরেশ্বর এসেছে। বীরেশ্বর সন্তুর ‘বীরু জ্যেঠু’, ওর বাবার বড় মামার ছেলে। বীরেশ্বর ঘরে ঢুকে সন্তুর ঠাম্মার সামনে এসে বলল, “পিসিমা, আমি এসে গেছি। আর তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। ডেড বডি নিয়ে যাবার জন্য কাঁচের গাড়ি এক্ষুনি এসে যাবে”। কাঁচে ঢাকা গাড়ির কথা শুনে বীরেশ্বরের পিসিমা খুব রেগে গেলেন। সন্তুর বাবাকে ডেকে বললেন, “মড়া বাপের জন্য একটু কাঁধ দিতে পারবি না তোরা? এ কেমন ছেলের জন্ম দিয়েছি আমি!” পরিস্থিতি সামাল দিতে বীরেশ্বর তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল, “আজকাল কাঁধ দেওয়া উঠে গেছে, পিসিমা। তুমি এ নিয়ে চিন্তা কর না”।

সংসারের কোন খুঁটিনাটি নিয়ে ওকে কোনদিনই চিন্তা করতে হয়নি। বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়িতে আসার পর, স্বামী দীপক ওকে ঠিক একই ধরনের কথা বলে নিশ্চিন্ত করে রাখত, “তুমি কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করবেনা। কোন অসুবিধে হলে আমাকে বলবে। আমি সব বন্দোবস্ত করে দেব। এই নিয়ে একদম ভাববে না।” নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া লোকটির এই কথায় বিদিশার কীসের যেন এক দুর্বলতা জন্মে গিয়েছিল ওর প্রতি। অল্প বয়স বলে আতিশয্য একটু বেশিই দেখিয়ে ফেলেছিল ননদ আরতির কাছে, “জানো ঠাকুরঝি, তোমার দাদা আমাকে কি বলেছে?” আরতি আর বিদিশা প্রায় সমবয়সী এবং বন্ধুর মত। আরতি বিদিশার আদিখ্যেতা দেখে রেগে গিয়ে বলেছিল, “আমার দেখে কাজ নেই বৌদি। ঘরে অবিবাহিতা বিয়ের যোগ্য বোন থাকতে তার বিয়ের কথা না ভেবে, নিজে গেল ছাদনা তলায় বিয়ে করতে। আমার বিয়ের ব্যবস্থা করতে বল দাদাকে।” ঠাকুরঝির মনের ভাব বুঝতে পেরে বিদিশার নিজেকে দোষী মনে হত সেই সময়ে। দীপকের কাছে একদিন কথাটা পেড়েও ছিল। দীপক বলেছিল, “আমি কি আর চুপ করে বসে আছি ভাবছ? ঘটক লাগিয়েছি, যাতে ভাল ঘরে বিয়ে হয়। কিন্তু জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে তো তাঁর হাতে। অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই। তুমি এই নিয়ে একদম চিন্তা করনা।”  

স্বামী মারা যেতে তাকে নিয়ে স্মৃতিগুলো যেন ছায়াছবির মতো মনের পর্দায় জেগে উঠতে থাকল। শুধুমাত্র সন্তানের জন্ম দেওয়া ছাড়া, সংসারের কোন ব্যাপারেই বিদিশার বিশেষ কোন অবদান নেই। প্রথম সন্তানের জন্ম দেবার পর দীপক ডাক্তারের নির্দেশের কথা বিদিশাকে জানিয়ে বলেছিল, “ডাক্তার এখন তোমাকে বেশ কিছুদিন সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে বলেছে। আরতিকে বল সংসারের কাজকর্ম এখন থেকে যেন ও-ই দেখে।” তখন থেকেই আরতি সংসারের দায়িত্ব পুরোপুরি নিজের কাঁধে তুলে নিল। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সেখান থেকে আর সে বেরোয়নি।

প্রথম প্রথম বৌদির কাছে জানতে চাইত, “আমার বিয়ের ব্যাপারে দাদা কি কিছু বলল?” সন্তোষজনক কোন উত্তর বিদিশা দিতে পারেনি। দীপক বাড়ি ফিরলে বিদিশা তার কাছে জানতে চাইতো আরতির বিয়ের ব্যাপারে। দীপক বলত, “পাত্রপক্ষ ভাল দিন দেখে আসবে বলেছে”। কিন্তু আরতিকে দেখতে আসার জন্য তারা আর ভাল দিন খুঁজে পায়নি কখনো। একদিন আরতি দেখতে পেল তার চুলে পাক ধরেছে। আরতি বিদিশার কাছে জানতে চেয়েছিল, “দ্যাখতো বৌদি, চুলটা সত্যি পাকা কিনা”। বিদিশার তখনও একটা চুলও পাকেনি। খানিকটা তৃপ্তিমাখা স্বরে সে আরতিকে বলল, “হ্যাঁ ঠাকুরঝি, এটা পাকা চুলই”। তাই শুনে বৌদিকে জড়িয়ে ধরে সেদিন খুব কেঁদেছিল আরতি। বিদিশার এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে সেই দিনের কথা। তারপর থেকে আরতিকে আর কোনদিন কাঁদতে দেখেনি বিদিশা। 

নিজের জীবনের ঘটে যাওয়া অতীত নিয়ে কোনদিন ভাবেনি বিদিশা। অথচ তার স্বামীর  মৃত্যুর পরের মূহুর্ত থেকে তার জীবনের এক-একটা ঘটনা অতীতের পাতা থেকে মনের পর্দায় উঠে আসছে। সেইসব দৃশ্য দেখতে-দেখতে বিদিশার তন্দ্রা মত এসে গিয়েছিল। ‘হরি’ ধ্বনি শুনে তন্দ্রা কেটে গেল। দীপকের দেহ ঘর থেকে বের করে কাঁচ ঢাকা গাড়ীতে শোওয়ানো হয়েছে। শ্মশানের উদ্দেশ্যে রওনা দেবার আগে ‘হরি’ ধ্বনি দিয়ে যাত্রা শুরু করতে হয়। ঘরের মধ্যে বিদিশা আর আরতি ছাড়া আর কেউ নেই। দীপকের দেহ ঘরের বাইরে নিয়ে যাবার পর আরতি জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ‘ঠাকুরঝি’ ডাক শুনে জানলার পর্দা নামিয়ে বৌদির সামনে এসে বসল।

“জানো বৌদি, দাদার বদলে আমি মরে গেলে বোধহয় ভাল হত।”

“কেন একথা বলছ?”

“দাদার পেনশনটা বন্ধ হয়ে গেল। এতগুলো পেট চলবে কি করে এখন? অরুণের চাকরি একমাত্র ভরসা।”

“তোমার দাদা বলেছিল, ‘আমি মরে গেলে তোমার কারো কাছে হাত পাততে হবে না। আমার পেনশনের একটা অংশ তুমি আমার উইডো হিসেবে পাবে’।”

কয়েক মুহূর্ত দুজনের কারোর মুখে কোন কথা নেই। অনেকক্ষণ আরতির দিকে তাকিয়ে থেকে বিদিশা আরতিকে বলল, “তুমি কি কাঁদছো, ঠাকুরঝি?”

“কার জন্যে কাঁদবো? বড় হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত যে দাদা কোনদিন ডেকে কথা বলেনি, তার জন্য?”

“তুমি সেই দাদাকেই খুব আন্তরিকতার সাথে ‘ভাই ফোঁটা’ দিতে, ‘রাখি’ বাঁধতে।”

“‘ভাই ফোঁটা’ দিয়ে আর ‘রাখি’ বেঁধে ওর সুস্থ থাকার কামনা করতাম। ও সুস্থ থাকলে আমার খাওয়া-পরাটা বন্ধ হবে না। আমি তো তখন থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে একজন কাজের লোক। তবে বাড়ি থেকে যে বের করে দেবে না, সেটা বুঝতাম।”

“তুমি বুঝতে পেরেছিলে তোমার দাদা যে তোমার বিয়ে দিতে চায়নি?”

“হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছিলাম।”

“আমি খুব অন্যায় করেছিলাম সেই সময়। একবারও তোমার বিয়ের জন্যে তোমার দাদাকে চাপ দিইনি। পরপর আমার সন্তান হয়ে গেছে। তুমি তাদের দেখাশুনো করেছ, আমি ক্লান্ত শরীরে শুয়ে-শুয়ে তা দেখতাম।”

যারা শ্মশানে গিয়েছিল তারা ফিরে এসেছে। বিদিশা আরতিকে বলল তাদের সাথে কী-কী করণীয় দত্তগিন্নীর কাছ থেকে জেনে সেরে ফেলতে। ঘরে একাই বসে আছে বিদিশা। সন্তু মাঝে-মাঝে এসে দেখে যাচ্ছে ঠাম্মাকে। কি যেন ওর মনে হয়েছে; কখনো গালে হাত দিয়ে, কখনো গলা জড়িয়ে ধরে ঠাম্মাকে দেখছে। বিদিশা সন্তুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। 

বড়ছেলের গলার আওয়াজ শুনতে পেল বিদিশা। মাকে খুঁজছে সে। ঘরে ঢুকে মার সামনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বলল, “বাবার ফিক্সড ডিপোজিটগুলো ভাঙতে হবে।”

“কেন?”

“তা না হলে এত খরচ সামলাতে পারব না।”

বিদিশা ছেলের কথার উত্তর দিলনা। অরুণ তার ঝোলাব্যাগ থেকে কয়েকটা ফর্ম বের করে মাকে দিয়ে বলল,টিক দেওয়া জায়গা গুলোতে সই করে রেখো; আর এফ.ডি সার্টিফিকেটগুলো বের করে রেখো।”

“কতজন লোককে বলছিস?”

“সাড়ে তিনশো ছাড়িয়ে যাবে।”

“এতো লোককে পাত পেড়ে খাওয়ানোর মত পয়সা কি তোর আছে? শুধু শ্মশান বন্ধুদেরই বলবি আর যে ব্রাহ্মণ শ্রাদ্ধ-শান্তির কাজ করবে, তাকে বলবি খাবার জন্যে। আর কাউকে বলার দরকার নেই।”

“মা, এতে পাড়াতে, আত্মীয়স্বজন মহলে মান-সম্মান থাকবে না। যাই হোক, আমি এখন উঠি; অনেক কাজ পড়ে আছে। আর হ্যাঁ, বাড়ির দলিলটাও বের করে রেখো।”

বিদিশা বড়ছেলের কথার কোন জবাব দিলনা। অরুণ কয়েক মূহুর্ত অপেক্ষা করেছিল তার মা কি বলে তা জানার জন্য। একদিন বাদ দিয়ে পরের দিন দুপুরবেলা সে তার মায়ের কাছে এল। বিদিশা তাকে দেখে বলল, “বাপের সম্পত্তি কবজা করতে এসেছিস যখন, বাবার দায়টাও বুঝে নে এই বেলা।”

“বরুণ আর কিরণমালা ছাড়া বাবার তো কোন দায় থাকার কথা নয়। আমিতো মোটামুটি একটা চাকরি করছি। আবার কোন দায় বাবার রয়ে গেছে?”

দু’জনের কথাবার্তার ফাঁকে আরতি ঘরে এসেছিল তার বৌদিকে কিছু বলবে বলে। মা আর ছেলের কথার ঝাঁঝে বেরিয়ে যাচ্ছিল ঘর থেকে। বিদিশা যেতে বারুণ করল।

“এই যে তোর পিসিকে দেখছিস, আমার বিয়ের আগে ওর বাবা মারা যান। তোর ঠাকুরদা কর্মরত অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন বলে তোর বাবা চাকরিটা পেয়ে যায় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। তার একবছর পর তোর বাবা আমাকে বিয়ে করে নিয়ে আসে। তোর জন্মের পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। তোর পিসি সেই যে সংসারের মধ্যে ঢুকল, আজও তার থেকে মুক্তি পায়নি। পিসির বিয়ে দেওয়ার কথা তোর বাবা একবারের জন্যেও ভাবেননি।”

“এইসব কথা তুমি বাবাকে বলনি কেন? দায় তো বাবার, আমার নয়।”

“তোর এই পিসী তোকে নাইয়ে-খাইয়ে কোলে-পিঠে করে বড় করেছে। মায়ের থেকেও বেশী করেছে তোদের জন্যে। তোরা ছাড়া ওর তো কেউ নেই। কে দেখবে ওকে?”

“আমি আর কত দায়িত্ব কাঁধে নেব, মা? আমার আয় তো বিরাট কিছু নয়। আমারও তো বৌ, ছেলে, মেয়ে রয়েছে। তাদের কথাও তো ভাবতে হবে।”

“বুঝতে পারছি, তুই তোর বাপের যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে উঠেছিস। আমি এতদিন তোর বাবার ওপরে নির্ভরশীল ছিলাম। নিজের ইচ্ছেয় কিছু ভাববার বা করবার স্বাধীনতা আমার তখন ছিল না। মরে গিয়ে তোর বাবা আমার চোখ খুলে দিয়েছে। কোনদিন বুঝতে পারিনি নিজের নামে বাড়ি হলে তার অনুভূতি কেমন হয়। মাসে-মাসে তোর বাবার উইডো পেনশনের টাকা দিয়ে কি করব, এখন থেকে তা ভাবতে হবে। লকারটা তোর বাবার সাথে জয়েন্ট একাউন্টে আছে। এতদিন তোর বাবাই যা করার করত। এখন আমি ছাড়া কেউ খুলতে পারবে না।”    

“কিন্তু মা, আমি তো এখন হেড অফ দ্য ফ্যামিলি। সবকিছু তো আমার হেফাজতেই থাকা উচিৎ, তাই না?”

“মড়া বাবাকে কাঁধে করে শ্মশানে নিয়ে যাবার মত কর্তব্যটুকুও তো করে উঠতে পারোনি। ফ্যামিলির হেড হতে গেলে অনেক দায়িত্ব আর কর্তব্য পালন করতে হয় বাবা। সে সব করে তবে না হয় ‘হেড অফ দ্য ফ্যামিলি’ হোয়ো।”

শ্রাদ্ধের দিন সকাল বেলা বাড়ির ছাদে প্যান্ডেল বাঁধা হচ্ছে। সন্তু ঠাম্মার কাছে জানতে চাইল,  “ছাদে প্যান্ডেল বাঁধছে কেন, ঠাম্মা?” সন্তুর ঠাম্মা সন্তুকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “এখানে তোমার দাদু আর তাঁর পূর্ব-পুরুষদের করে যাওয়া ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হবে। তারপর তাঁদের প্রেতাত্মাদের পিন্ডদান করে মুক্তি দেওয়া হবে। তাই প্যান্ডেল বেঁধে ছাউনি টাঙানো হচ্ছে দাদুভাই”।

Tagged with: , ,