থিটাবাবুর মুশকিল আসান

স্বর্ণাংশু নন্দী

Posted On: June 13, 2021

থিটাবাবু পড়েছেন মহাবিপদে। কি যে করবেন কিছুতেই ভেবে উঠতে পারছেন না। একে লকডাউনে বাজার চড়ছে, সেসব চিন্তা করে করে তাঁর প্রেশারও উর্ধ্বমুখী। তার উপর আর এক ঝামেলা ঘাড়ে এসে পড়েছে। থিটাবাবু মেরি চাইল্ড ইংলিশ স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক। তাঁর শিক্ষকতার এই তিরিশ বছরে এমন দিন তিনি কখনও দেখেননি। অনেক মন্দা দেখেছেন। তাঁর প্রাইভেট স্কুলের অনেক দুর্দিনেরও সাক্ষী তিনি। কিন্তু আজকের মত পরিস্থিতি তিনি কস্মিনকালেও কল্পনা করতে পারেননি। রিটায়ারমেন্টের দু’মাস আগে এত ভোগান্তি! এসব ভেবে মাঝে মাঝে মাথায় হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন থিটাবাবু। মাথার কথা এলো যখন, বলে রাখি তাঁর এই মাথার কারণেই কিন্তু ‘থিটাবাবু’ নামটি প্রচলিত। যদিও এর উদ্ভব হয়েছিল অন্য একটা মাথা থেকে। প্রতিটা স্কুলের প্রতি ক্লাসেই কিছু মার্কামারা ছেলে থাকে, তারা প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকার বাপ-মায়ের দেওয়া নামকে অপসারিত করে সেই জায়গায় তাদের পছন্দসই একটা সুশ্রাব্য নাম বসিয়ে দেয়। তেমনই আমাদের ক্লাসে ছিল ছেনো। ছেনোর মাথা থেকে সেদিন এই নামটা বেরিয়েছিল, যেদিন জ্যামিতির একটা কোণ আঁকতে না পারার জন্য বেঞ্চের ওপর কান ধরে দাঁড়াতে হয়েছিল তাকে। বেঞ্চের ওপর থেকে ছেনো অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিল সুব্রতস্যারের মাথাটা। তাঁর বিশাল মাথার মাঝ বরাবর কয়েকটি মাত্র চুল একসাথে জড়ো হয়ে মাথার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চলে গেছে, ওপর থেকে দেখলে ঠিক গ্রীক অক্ষর থিটা-র মত লাগে। ব্যাস, সুব্রতস্যারের নাম সেদিন থেকে পাল্টে হয়ে গেল থিটাবাবু। 

    সকাল থেকে উসখুস করছেন। যে চা না খেলে তাঁর দিন চলে না, সেই চায়ের কাপ আজ ফাঁকা হয়নি, অর্ধেকটা পড়ে আছে এখনও। এসব দেখে তাঁর গিন্নী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি গো, তোমার শরীর-টরীর সব ঠিক আছে তো!’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওসব ঠিক আছে।’

‘তবে এমন অস্থির লাগছে কেন তোমায়?’

‘আর বোলোনা, বড্ড সমস্যা। স্কুল থেকে ফোন এসেছিল।’

‘সেকি! এই অবস্থায় আবার তোমার স্কুল খুলবে নাকি?’

‘খুললে তো বেঁচে যেতাম গো।’

‘খোলসা করে বলো দেখি ব্যাপারখানা— স্কুল থেকে কি বললো?’

স্কুল থেকে ফোন করে তাঁকে অনলাইনে ক্লাস করাতে হবে নির্দেশ দেওয়ায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে থিটাবাবুর। সব শুনে ‘এ তো ভালো কথা’ বলে তাঁর গিন্নী রান্নাঘরে নিজের কাজ গোছাতে চলে গেলেন। 

‘তুমি তো ভালো বলেই খালাস। এমন করে আবার পড়াশোনা হয় নাকি, ধুত্তোর!’ রেগেমেগে একটা থলে নিয়ে মুখে মাস্ক এঁটে হাঁটা লাগালেন বাজারের দিকে। 

    বাজারে গিয়েও ঝামেলার শেষ নেই। চারদিকে লোক থিক থিক করছে। ‘এত করে মাইকে প্রচার করছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য, কিন্তু কে কার কথা শোনে। এমনভাবে চলতে থাকলে দেশটা যে একেবারে উচ্ছন্নে যাবে!’ বিড়বিড় করতে করতে শেষমেশ ঢুকেই পড়লেন বাজারের ভেতর। সোজা চলে গেলেন তার বিশ বছরের চেনা মুদির দোকানে। বাজারে বেশ ভিড় থাকলেও এই দোকানটা বাজারের অন্য পাশে হওয়ায় ভিড়টা একটু কম। তার উপর এক ছোকরা লাঠি হাতে বাইরে লাইন করাচ্ছে, যাতে সবাই ভালোভাবে জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। চটপট গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পরলেন থিটাবাবু। দু’-চারজনের পেছনেই উনি। আধঘণ্টা বাদে ওনার পালা এলো। গিন্নীর কাছ থেকে কি লাগবে না লাগবে বেরোনোর সময় জানাই হয়নি তাঁর। তাই নিজেই নিজের মত করে কটা জিনিসের ফর্দ বানিয়ে ফেলেছিলেন থিটাবাবু। সেই ফর্দখানা শ্যামলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ও শ্যামল, এই গুলো একটু দিয়ে দে তো বাবা।’ শ্যামল তাঁর স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই এই দোকান সামলাচ্ছে সে। ‘ছেলেটার মাথা আছে সুনীল, কক্ষনও ওর লেখাপড়া বন্ধ করবেনা। এ ছেলে একদিন বড় হবেই।’ একবার সরস্বতী পুজোয় বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে বাড়ির ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা যায় দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল শ্যামল। সেখানেই ওর বাবা সুনীল হালুইকে ডেকে একথা বলেছিল থিটাবাবু। কিন্তু ভাগ্যের লিখনে শ্যামলের পড়া আর এগোয়নি ঠিকই, তবে মাথাটা সেই আগের মতই প্রখর। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে ফর্দ মিলিয়ে সব জিনিস গুছিয়ে দিল শ্যামল। ‘এই নিন মাষ্টারমশাই।’ বলে থলেটা থিটাবাবুর দিকে এগিয়ে দিতেই উনি পকেট থেকে একটা দু’হাজারের নোট বের করে শ্যামলের হাতে দিলেন।

‘বড় মুশকিল হয়ে গেল মাষ্টারমশাই।এখন আপনাকে ফেরত দিই কেমন করে— এই দোকান খুললাম!’

‘ঠিকাছে, ঠিকাছে পরেই দিবি না হয়। আবার তো আসব।’

‘সে ঠিকাছে মাষ্টারমশাই। কিন্তু আপনাকে একটা কথা বলি, এখন যতটা পারবেন ক্যাশ পেমেন্ট কম করুন। এই যে আমায় সরাসরি ব্যাঙ্কে টাকা পাঠাতে পারবেন এই অ্যাপ দিয়ে’— এই বলে বাইরে টাঙানো একটা ছোট পোস্টারের দিকে দেখাল শ্যামল। থিটাবাবু মুচকি হেসে আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগালেন। যেতে যেতে ভাবলেন গোটা বিশ্বে তিনিই যেন একা পিছিয়ে পড়েছেন, আর সবাই তাঁর পাশ দিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে ক্রমাগত। একটু থমকে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথাটা নাড়িয়ে আবার হাঁটা লাগালেন।   

    থিটাবাবু আজীবন এইসব অত্যাধুনিক টেকনোলজি, মোবাইল, ল্যাপটপের ঘোর বিপক্ষে। তিনি মনে করেন তাঁর ছাত্রজীবনে যেমনভাবে পড়াশোনা হত, তাতে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে  যেমন একটা সুসম্পর্ক ছিল, তেমন পড়াশোনার মানও ছিল যথেষ্ট উচ্চ। আর এখন এইসব গ্যাজেট এসে সব সম্পর্ক যেমন তলানিতে এসে ঠেকেছে, তেমন শিক্ষার মানও। সবাই মুখ গুঁজে ব্যস্ত নিজের নিজের জগতে। বাইরে তো বটেই, ঘরেও এসবের সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে। এই তো গত পরশু সন্ধ্যেবেলা তিনি গিন্নীকে বললেন একটু মুড়ি মেখে দেওয়ার জন্য। বার কয়েক বলার পরও পাশের ঘর থেকে কোনও সাড়া পেলেন না, অথচ টিভি তো চলছে না যে গিন্নী শুনতে পাবেনা। অগত্যা পাশের ঘরে গিন্নীকে ডাকতে গিয়ে দেখেন গিন্নী খাটের ওপর বালিশে গা এলিয়ে বহাল তবিয়তে কানে ইয়ারফোন গুঁজে সিনেমা দেখছেন আর মাঝে মাঝে হেসে উঠছেন। তাঁর দিকে কোনও নজরই গেল না গিন্নীর। অবশেষে থিটাবাবু নিজেই মুড়ি মেখে খেয়ে নিলেন। তাঁর মেয়েও এ যুগের, তাই ভূমিষ্ঠ হওয়ার আঠারো বছর পেরোতে না পেরোতেই তারও হাতে একটা ঝাঁ চকচকে মোবাইল ঘুরে বেড়ায়, পড়াশোনার কাজে নাকি খুব লাগে। তবে তার পরে মেয়ে কলেজে ভর্তি হলে ল্যাপটপও কিনে দিয়েছেন। সেটাও নাকি ওই একই কাজে লাগে। তবে সেটা যে কিভাবে তা তিনি নিজে শিক্ষক হয়েও আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেননি। কিন্তু আজ তো তাঁর নিজের কাজেই সেসবের শরণাপন্ন হতে হবে, এই ভেবেই তাঁর বিরক্তি লাগছে। যে ছাত্রছাত্রীদের তিনি এতদিন ধরে উপদেশ দিয়ে এসেছেন যে মোবাইল, ল্যাপটপ এসব পড়াশোনার ক্ষতি করে, তাই তারা যেন ওসব স্পর্শও না করে। আজ সেই আদর্শ, উপদেশ সব জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁকে অতি আধুনিক হয়ে উঠতে হবে। কত কথাই বলতেন, মোবাইল কাছে রাখার অপরাধে কত ছাত্রছাত্রীকে শাস্তিও দিয়েছেন। আজ তাদেরকেই হাতে মোবাইল, ল্যাপটপ তুলে নেওয়ার কথা বলতে হবে তাঁকে— এসব ভেবে যেন তাঁর কান্না আসছে।

‘আরে চিল ড্যাড, অত ভেবো না। আমি আছি তো। মা আমায় সব বলেছে।’ দুপুরে খাবার টেবিলে এভাবেই থিটাবাবুকে তাঁর একমাত্র কন্যা আশ্বস্ত করল। ‘কি সব ভাষা!’ মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে অর্ধেক খেয়েই উঠে গেলেন। পাশের ঘরে গিয়ে বাগানের দিকের জানলার পাশে এসে দাঁড়ালেন। আজ দিনটা বেশ মেঘলা, একটা হালকা ঠান্ডা হাওয়াও দিচ্ছে। অন্য কোথাও বৃষ্টি হয়েছে হয়ত! বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তাঁর চোখ গেল সামনের গাছটার দিকে। গাছের মাঝখানে কাক বাসা করেছে। বাচ্চা পাখিগুলো কিচিরমিচির করছে অনেকক্ষণ, বোধহয় খিদে পেয়েছে। দেখতে দেখতে থিটাবাবু লক্ষ্য করলেন একটা কাক পাশের গাছের ডালে বসে আছে। ‘ওটাই ওদের মা হবে হয়ত’, ভাবনাটা যে ভুল নয় একটু পরেই তা মালুম হল। মা কাকটা পাশের গাছের ডাল থেকে একটা পাটকাঠি ওর বাসার গায়ে লাগিয়ে দিয়েছে। যেন পাশের গাছের ডাল থেকে ওই বাসা অবধি একটা ব্রিজ তৈরি হয়েছে। তারপর থিটাবাবু লক্ষ্য করলেন কিছুক্ষণ বাদে মা কাকটা পাশের গাছ থেকে ছোট ছোট ফলগুলো ঠোঁটে করে ওই পাটকাঠির ভেতরে পুরে দিচ্ছে যাতে তা সরাসরি ফাঁপা পাটকাঠি দিয়ে এসে পড়ছে পাশের বাসায়। বারবার করে মা পাখিকে উড়ে এসে তার ছানাদের খাবার দিতে হচ্ছেনা। সহজেই তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ফেলতে পারছে সে। ব্যাপারটা বেশ নাড়া দিল থিটাবাবুকে। চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়লেন খাটে। 

বিকেলে উঠে সোজা চলে গেলেন মেয়ের ঘরে। ‘আমায় একটু অনলাইন ক্লাস করাটা শিখিয়ে দিবি রুমি?’

রুমি তখন মন দিয়ে নতুন ওয়েবসিরিজ দেখছে ল্যাপটপে। এ যে ভূতের মুখে রামনাম! ঠিক শুনছে তো সে? রুমি বিশ্বাস করতে পারছিল না তাঁর কানকে। থিটাবাবু ঝটকা দিলেন, ‘এই রুমি’। 

এবার রুমির বিশ্বাস হল যে সত্যিই তার বাবা আজ এই অত্যাধুনিক জগতে প্রবেশ করতে চাইছে— ‘কিন্তু বাবার হলটা কি!’

মেয়ের মুখ দেখেই তার ভাবনাটা আন্দাজ করতে পারলেন থিটাবাবু— ‘ভাবছিস তো, বাবার কি হল?’ দুপুরের পাখির গল্পটা খুলে বললেন মেয়েকে। ‘ভেবে দেখ রুমি, বারবার উঠতে হবে বলে আমাদের যেমন রিমোট আবিষ্কার হয়েছিল, ঠিক তেমন কারণেই কাকটা কি সুন্দর একটা ব্যবস্থা করেছে তার ছানাদের জন্য। ওরাও আস্তে আস্তে আধুনিক হয়ে উঠছে বোধহয়। তবে আমি আর বসে থাকি কেন! অনেক ভেবে দেখলাম, এসব মোবাইল, ইন্টারনেট আমাদের এগিয়ে দিচ্ছে ঠিকই। কিন্তু আমরা যদি আমাদের পিছন ফিরে তাকাতে ভুলে যাই তবে তা ক্ষতিকর। এটা ভালো কাজে ভালভাবে আমরা ব্যবহার করব, কি বল?’

রুমি হালকা হেসে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘কি সুন্দর বললে বাবা, ইয়ে হুয়ি না সোচ্ মাষ্টারজি!’’

‘পাজি মেয়ে’, এই বলে হেসে উঠল বাবা-মেয়ে।

Tagged with: