অদ্রীশকাকা, বাবা আর কল্পবিজ্ঞান

সন্দীপ রায়

Posted On: June 5, 2021

অদ্রীশ বর্ধন চলে গিয়েছেন প্রায় মাস চারেক হল। বয়সের কারণেই শারীরিকভাবে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন—সেরকমই শুনেছি। সত্যি কথা বলতে কী, বাবার মৃত্যুর পর থেকে অদ্রীশকাকার সঙ্গে সেরকম আর যোগাযোগ ছিল না। তবে হ্যাঁ, মাঝেমধ্যেই ‘ফ্যানট্যাসটিক’ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যা উনি আমাকে বাড়িতে পাঠাতেন। নিয়মিত সেগুলো পড়তাম। শেষদিকে যোগাযোগ বলতে এইটুকুই। অবিশ্যি অদ্রীশকাকা-কে নিয়ে আগের এত স্মৃতি রয়েছে যে অগত্যা না বলে উপায় নেই।

 যতদূর মনে পড়ছে একটা বৃষ্টির দিনে অদ্রীশকাকা বাবা-কে প্রথম ফোন করেন। বাবা ইতিমধ্যেই ওঁর কিছু কাজকর্ম এদিক-ওদিক দেখেছেন-শুনেছেন। কাজেই গোড়াতেই পরিচয় পর্বটা খুব বড় কিছু ছিল না বলেই মনে হয়। বাবা টেলিফোনে বললেন, ‘বেশ। তা একদিন চলে এলেই হয়।’ তো, সেই প্রথম অদ্রীশ কাকা আমাদের বাড়িতে এলেন। তখন আমরা লেক টেম্পল রোডের ভাড়া বাড়িতে থাকি। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজে অদ্রীশকাকা আমাদের বাড়িতে এসেছেন। পরে যখন আমরা বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে উঠে এলাম—এখানেও অদ্রীশকাকা এসেছেন। বাবার একটা অদ্ভুত স্নেহ ছিল ওঁর প্রতি। কারণটা ডেফিনেটলি কল্পবিজ্ঞানের প্রতি দুর্বলতা, ভালবাসা। বাবা যে কল্পবিজ্ঞানের বেজায় অনুরাগী ছিলেন—একথা তো সকলেই জানেন। যার জন্যই পরবর্তীকালে ‘সন্দেশ’-এর পাতায় প্রফেসর শঙ্কু’র আবির্ভাব। শঙ্কু সিরিজের ওঁর প্রথম গল্প ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়েরী’ ১৯৬১ সালেই ‘সন্দেশ’-এর আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ—এই তিন সংখ্যায় ধারাবাহিক ভাবে প্রথম প্রকাশিত হয়। এছাড়াও লিখেছেন ‘ময়ূরকণ্ঠী জেলি’ গল্পটা। যেটা নিয়ে পরবর্তীকালে আমি একটা টেলিফিল্ম-ও করি। তো যাই হোক, এসবটা থেকে বোঝাই যাচ্ছে বাবা কতটা সায়েন্স ফিকশনে অ্যাডিক্ট ছিলেন। যে কারণেই অদ্রীশকাকার সঙ্গে ওঁর একটা আশ্চর্য কেমিস্ট্রি তৈরি হয়ে গেল। সেই সময় অদ্রীশকাকা কল্পবিজ্ঞানের একটা মাসিক পত্রিকা বের করছিলেন, ‘আশ্চর্য !’ নামে। অবিশ্যি, তখন কিন্তু অদ্রীশ বর্ধন নামে নয়। আকাশ সেন ছদ্মনামে পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন। ওই ১৯৬৬ সালের শারদীয়া ‘আশ্চর্য !’-তেই বাবা লিখলেন—‘প্রফেসর শঙ্কু ও ভূত’। এর একবছর আগেই অর্থাৎ ১৯৬৫-এর শারদীয়া সংখ্যা (১৩৭২ বঙ্গাব্দ) ‘আশ্চর্য !’-তেই লিখেছিলেন ‘ময়ূরকণ্ঠী জেলি’। মজার বিষয় ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ গল্পটি বাবা যে খসড়া খাতায় লিখেছিলেন, সেই খাতারই শেষদিক থেকে লেখা শুরু হয়েছে ‘ময়ূরকণ্ঠী জেলি’ গল্পটি।

এর কিছুদিন বাদ থেকেই ‘ফ্যানট্যাসটিক’ পত্রিকা বের করতে শুরু করেন অদ্রীশকাকা। তখন সেই পত্রিকার জন্য বাবা একটি লোগো-ও করে দিয়েছিলেন।

১৯৬৬ সালেই অদ্রীশকাকা ‘সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাব’ তৈরি করেছিলেন। বাবা-কে প্রেসিডেন্ট করতে চাইলেন। আর বাবা কী ‘না’ করতে পারেন ! এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। এবং উল্লেখযোগ্য বিষয় এটা কিন্তু সারা পৃথিবীর মধ্যে প্রথম ‘সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাব’। বাবা সেই সময় আর্থার সি ক্লার্ক, রে ব্র্যাডবেরি, আইজ্যাক অ্যাসিমভ—এঁদের সকলকে চিঠি লিখেছিলেন। এবং এঁরা সকলেই কিন্তু চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, আমরা সশরীরে উপস্থিত থাকতে পারছিনা ঠিক কথাই। কিন্তু, মানসিক ভাবে সবসময় সঙ্গে আছি। এমনকি বাবা ওয়াল্ট ডিজনিকেও চিঠি লিখেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন—“I wish all the best to the newly formed SF Cine Club. I think anything we can do today to enlighten and bring culture into the lives of young folks is worthy of the fullest encouragement.”

এছাড়াও আরও অজস্র চিঠিচাপাটি ছিল। এখন ভাবলে আফসোস হয়, ওয়াল্ট ডিজনি বা ওঁদের বাবাকে লেখা চিঠিগুলো আর একটাও আমাদের কাছে নেই। আমি জানিনা, অদ্রীশকাকার কাছে সেগুলো ছিল কিনা—কিংবা আদৌ এখন আর আছে কিনা !

সেসময় পশ্চিমের বিভিন্ন দেশগুলোতে বাবার বেশ ভাল পরিচিতি হয়ে গিয়েছে। কাজেই বাবা সকলকে নিজেই যোগাযোগ করে বলেছিলেন, তোমাদের যদি নতুন কোনও সায়েন্স ফিকশনের ছবি আসে, তাহলে আমাদের সিনে ক্লাবে দিও—আমরা প্রিমিয়ারটা করব। আর পাশাপাশি, কলকাতার বিভিন্ন কনস্যুলেটগুলো তো ছিলই। বিভিন্ন বড় স্টুডিয়ো—টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স-এর অফিস ছিল, এমপ্লিএম-এরও ছিল। তাঁরা সবাই এগিয়ে এলেন।

এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে, সেই সময় অ্যাসিমভের গল্প অবলম্বনে ‘ফ্যান্টাসটিক ভয়েজ’ নামে একটা ছবি হয়েছিল। সেটার প্রিমিয়ার হয় আমাদের এই ‘সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাবে’। এছাড়াও আর অনেক ছবিই দেখানো হয়েছিল। সেই সময় প্রায় প্রত্যেকটি প্রধান হলিউড কোম্পানিগুলোর একটা করে ১৬ মিলিমিটারের ফিল্ম লাইব্রেরি ছিল। সেসব লাইব্রেরি থেকে বাবা নিজে ছবি বাছতেন। অনেক ছবি এভাবে এসেছে, এখানে দেখানো হয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যবশত পরে ছবি পাওয়া কঠিন হয়ে গেল। এতও ভাল একটা উদ্যোগ এর আগে কেউ কখনও কিন্তু নেননি। কাগজে প্রচুর লেখালিখি হয়েছিল এই প্রসঙ্গে।    

শুধু বাবা-ই নন। এর পেছনে কিন্তু আরেকজন মানুষ ছিলেন—অদ্রীশকাকা। সব ব্যাপারটায় যোগাযোগটা উনিই করতেন। অসম্ভব এনারজেটিক মানুষ ছিলেন—সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। অদ্রীশকাকা ‘সন্দেশ’-এও লিখেছিলেন। ‘প্রোফেসর নাটবল্টু চক্র’-র একটা গল্প প্রকাশিত হয় ‘সন্দেশ’-এ। এছাড়া ওঁর ‘ইটি’ বইটিও আমার খুব পছন্দের।

এর আগে ‘আশ্চর্য !’ বাবা-কে নিয়ে একটি সংখ্যা প্রকাশ করে। যেখানে বাবার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়াও অবিশ্যি আরও কয়েকটি বাবার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় কল্পবিজ্ঞানের উপর। এর বেশীরভাগই অদ্রীশকাকার নেওয়া।

১৯৬৭ সাল নাগাদ বাবা একটি স্ক্রিপ্ট করতে শুরু করেন, যার তিনটে পরপর নামকরণ বাবা করেন। যথাক্রমে—‘অবতার’, ‘মঙ্গল-কাব্য’ আর ‘The Alien’। শেষ পর্যন্ত এই তৃতীয় তথা শেষ নামটিই ফাইনাল হয়েছিল। এবং সেটি থেকে সিনেমা করার পরিকল্পনা তো ছিলই, এমনকি লোকেশন দেখাও হয়ে গিয়েছিল। আর তার পরের ঘটনা তো সবারই জানা। ছবিটা না হওয়া একটা বিরাট লস সকল কল্পবিজ্ঞান প্রেমীদের কাছে ! যদিও, অনেক পরে বাবার মূল ইংরেজি লেখাটা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন শংকরলাল ভট্টাচার্য। যেটা ‘সন্দেশ’-এই—সত্যজিৎ রায়ের অজানা উপন্যাস–‘অবতার’ নামে ছাপা হয়েছিল ধারাবাহিক ভাবে।

অদ্রীশকাকা, বাবা, প্রেমেন্দ্র মিত্র আর দিলীপ রায়চৌধুরী এঁরা চারজন মিলে ‘সবুজমানুষ’ নামে একটি কল্পবিজ্ঞানের লেখা লিখেছিলেন আকাশবাণী-র ‘সাহিত্যবাসর’ অনুষ্ঠানের জন্য। ১৯৬৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাত আটটা নাগাদ রেডিওতে বাবার গল্পটা বাবার নিজের ভাষ্যপাঠেই সম্প্রচারিত হয়। তাছাড়া বাকি তিনজন তো ছিলেনই।পরে,  অদ্রীশকাকা নিজের উদ্যোগে ‘সবুজমানুষ’ বই আকারেও প্রকাশ করেন। যেটা সম্প্রতি ‘কল্পবিশ্ব’ নামে একটি কল্পবিজ্ঞান প্রেমীদের সংস্থা আবার রিপ্রিন্ট করেছে।

আমার মনে পড়ছে ‘সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাবে’র প্রতিষ্ঠার দিনের কথা। ছিলেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রেমেন্দ্রমিত্র। আর সেদিন অদ্রীশকাকা ওঁর সেক্রেটারি পদ থেকে বলেছিলেন—“This is no doubt a great achievement of SF literature in Bengal. We hope more and our long-cherished dream will come true when we will have the opportunity to screen India’s first SF film classic produced in Calcutta by the daring genius Sri Satyajit Ray, our esteemed President…”

‘সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাব’-এর জন্য বাবা লোগো-ও করে দিয়েছিলেন। হইহই করে সাই-ফাই সিনেমাগুলো দেখান হত সেসময় ‘সিনেক্লাবে’। এই সিনেক্লাবের পেছনে অদ্রীশকাকার যে একটা বিরাট অবদান ছিল – সে কথা স্বীকার করতেই হয়।

আগেই বললাম, বাবা যেহেতু কল্পবিজ্ঞান সিনেমা, লেখালিখির পোকা ছিলেন, কাজেই সে দৌলতেই বাড়িতে অজস্র বিদেশি পত্র–পত্রিকা, বইপত্তর আসত। আমিই সেসব লেখা গোগ্রাসে গিলেছি একটা সময়। আইজ্যাক অ্যাসিমভ, আর্থার সি ক্লার্ক, রে ব্র্যাডবেরি-র লেখা আমার খুব পছন্দের। এখন আমার ছেলে সৌরদীপও এই দিকটাতে ঝুঁকেছে।

এই কল্পবিজ্ঞানের প্রতি আমারও একটা দুর্বলতা আর বাবার খুব ইচ্ছে ছিল ওঁর প্রফেসর শঙ্কু-র গল্প অবলম্বনে ছবি করার। কিন্তু,  সেটা তো বিভিন্ন কারণে উনি করে যেতে পারেননি। তাই অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করার পর বাবার ‘নকুড়বাবু ও এল ডোরাডো’  গল্প অবলম্বনে এবছর আমার ‘প্রফেসর শঙ্কু ও এল ডোরাডো’ ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে। যেখানে শঙ্কু-র চরিত্রে অভিনয় করেছেন ধৃতিমান দা, মানে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়। যাই হোক, সে তো অন্য প্রসঙ্গ। তবে হ্যাঁ, এবছরেই অদ্রীশকাকা চলে গেলেন। আমার ছবিটা দেখে যেতে পারলেন না—একথাটা ভেবে খারাপ লাগছে। 

এবার শেষ করব। যাওয়ার আগে আবারও বলতে ইচ্ছে করল বাবার সঙ্গে অদ্রীশকাকার কেমিস্ট্রি আর সর্বোপরি একে-অপরের প্রতি অগাধ ভক্তি–শ্রদ্ধা–ভালবাসা থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ, ঐ যে—কল্পবিজ্ঞান।