Suprava Ray : The Unvanquished — টুম্পা মুখোপাধ্যায়

বিদূষক

Posted On: June 10, 2021

সুকুমার রায় ও সত্যজিৎ রায় বিষয়ক বই সংখ্যায় বেশ প্রতুল। গবেষকরা তুলনামূলক নীরব সুপ্রভা রায়কে নিয়ে। অবশ্য এ আক্ষেপের পিছনে যথেষ্ট কারণও আছে, কিন্তু তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ আপাতত এখানে নেই। বক্তব্য এটুকুই যে, এ সম্পর্কেও যে আলোচনা করা যায়, তার প্রমাণ এই বইটা।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পুত্রবধূ, সুকুমার রায়ের স্ত্রী, সত্যজিৎ রায়ের মা এবং সন্দীপ রায়ের ঠাকুমা— এগুলো আদৌ সুপ্রভা রায়ের বিশেষণ হতে পারে? এ তো অন্যের পরিচয়ে বিশিষ্ট হওয়া। সুপ্রভা রায় তেমন মহিলা ছিলেন না মোটেও। তাঁর নিজস্ব পরিচয়ই নানামাত্রিক, বহুমুখী।
অন্তরালবর্তিনীদের এই এক অসুবিধা। তাঁরা যে অন্য অনেকের থেকে অনেক বেশি যোগ্য, অনেক বেশি তৎপর, অনেক বেশি কর্মঠ— অধিকাংশই তা মনে রাখে না। সুকুমার রায়ের ভাই সুবিনয় রায় সুপ্রভা রায়কে ডাকতেন ‘বজ্র বৌঠান’ বলে। সে কি এমনি এমনি?
ফিরে যাই একেবারে গোড়ায়। না না, সন তারিখের উল্লেখ করে আলোচনাকে ভারাক্রান্ত করব না একেবারেই, সে তথ্য গ্রন্থে সুলভ। আমি বলি, সুপ্রভা রায়ের হয়ে ওঠার প্রস্তাবনাটুকু। প্রতিষ্ঠিত ও কৃতী পরিবারের সন্তান সুপ্রভা রায়। প্রসাদরঞ্জন রায় যথার্থই বলেছেন— “It has been observed by some onlookers that she married into a famous family. I would hold that her family was no less illustrious.” জীবনের চৌকাঠেই যিনি পেয়েছেন বুদ্ধিবৃত্তির পাঠ, তিনি তো আর পাঁচজনের থেকে আলাদা হবেনই। অতঃপর সুপ্রভা রায়ের সঙ্গে সুকুমার রায়ের সম্পর্কসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার বিষয়টিও অনেকাংশে ঐতিহাসিক। অথচ এ বন্ধন স্থায়ী হল না। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে সুকুমার রায় চলে গেলেন না ফেরার দেশে, স্ত্রী এবং আড়াই বছরের সন্তানকে ফেলে রেখে। এ-ও এক ট্র্যাজেডিই।
লড়াই শুরু হল এরপরেই। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অনিশ্চিত অভিভাবকত্বের মধ্যেও সন্তানকে নিয়ে টিকে থাকার লড়াই। আলোচ্য বইয়ের লেখিকা সেই অধ্যায়ের যথার্থ নাম দিয়েছেন— “Negotiating The Private and The Public— The Double Burden”। এই তো হাল না ছাড়ার লড়াই। বহুজন পরিবেষ্ঠিত নিঃসঙ্গ বিধবার সংগ্রাম। আর সেখানেও তিনি সফল।
হেমিংওয়ের কল্পিত সান্তিয়াগোর মত সুপ্রভা রায়ের দার্ঢ্য। অবশ্য তাঁর ছিল অনেক উপরি গুণও। সুপ্রভা রায় ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী। রবীন্দ্রসঙ্গীত ও ব্রহ্মসঙ্গীতে তাঁর বেশ দখল ছিল। হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে তাঁর কোরাস গানের অ্যালবাম এ বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং এ নিয়ে কথা বলেন, চিঠিতে লেখেন— “মায়ার খেলার সুরগুলো ভুলে এসোনা যেন।” এই চিঠিতেই আছে সুপ্রভা রায়ের রবীন্দ্রনাট্য অভিনয়ের কথাও— “তবু তোমাদের মায়ার খেলার অভিনয় নিয়ে একরকম ভুলে ছিলুম— মনে হচ্ছিল মায়াকুমারীদের সুরের মায়াজালেই জগৎটা ঘেরা।” অবলা বসু প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাসাগর বাণীভবনে তিনি শেখাতেন সেলাই, এমব্রয়ডারি, চামড়ার কাজ, মাটির মূর্তি গড়া ইত্যাদি। প্রখ্যাত মৃৎশিল্পী নিতাই পালের কাছে তিনি শিখেছিলেন মৃৎশিল্প। গ্রন্থে ওঁর এইসব আর্ট-ওয়ার্ক বিষয়ক তথ্য ও ছবিও সন্নিবিষ্ট হয়েছে। শিল্পী সত্যজিৎ রায়ের শিরদাঁড়া নির্মাণে কার ভূমিকা ছিল সর্বাধিক, এ আর বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না।
বইটির আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, সুপ্রভা রায়ের পাশাপাশি তৎকালীন বাংলার নারীদের সামাজিকতা-লৌকিকতা ইত্যাদি বিষয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠে। সুপ্রভা রায়কে কেন্দ্র করে বর্ণিত হয়েছে নারীজাগরণের স্বপ্ন।
প্রতিটা অধ্যায়ই সুখপাঠ্য। তথ্যবহুল হলেও তথ্যভারাক্রান্ত নয়, যেটা লেখনীর অন্যতম গুণ। পরিশেষে সংযুক্ত হয়েছে টীকা, বিবলিওগ্রাফি। প্রোডাকশন বিষয়েও মন্দ লাগার জায়গা নেই একেবারেই।

বইয়ের নাম : Suprava Ray : The Unvanquished

লেখিকা : টুম্পা মুখোপাধ্যায় 
প্রকাশক : এভেনেল প্রেস। ২৫০.০০