হাতে সাতটি রান

অনীশ মুখোপাধ্যায়

Posted On: June 5, 2021

।। ১ ।।

স্যার, খেলবেন নাকি?

ধীমানের দিকে চায়ের গ্লাসটা বাড়িয়ে ধরে হাসি-হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে দোকানের মালিক মন্টু।

চায়ের দোকান থেকে কয়েক পা নেমে গেলেই সামনের বিশাল মাঠটায় ধীমান পা রাখতে পারে। তার দৃষ্টি এখন সেদিকেই নিবদ্ধ।

স্যার!

মন্টুর ডাকে ঘাড় ঘুরিয়ে এবার তার দিকে তাকাল সে। তারপর একটু হেসে চায়ের গ্লাসটা হাতে ধরে মাথাটা এমনভাবে নাড়ল যার মানে হ্যাঁ বা না, দুই-ই হতে পারে।

একটা নোনতা বিস্কুট এগিয়ে দিতে দিতে মন্টু জানতে চায়, আপনি খুব খেলা ভালবাসেন, তাই না? 

ধীমান চায়ে চুমুক দিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, কেমন করে বুঝলে?

বুঝি স্যার!

কিন্তু কেমন করে?

রোজ বিকেলে ক্লাস শেষে সবাই যে যার মতো বেরিয়ে যায়। কিন্তু আপনি সোজা এখানেই আসেন। তাই—

তোমার তো সবদিকে নজর দেখছি!

মন্টু বিস্কুটের বয়ামটা রেখে উৎসাহী গলায় বলল, আসলে আমিও খেলতাম স্যার। দোকানে বসে গিয়েই সব—

মন্টু থেমে যায়।

ধীমান বাকিটা বুঝে নিতে নিতে গ্লাসটা নামিয়ে রেখে দোকানের পেছনদিকের ঢালু জায়গাটা  দিয়ে মাঠে নেমে পড়ল। সন্ধ্যা হতে এখনও কিছুটা দেরি আছে। শিলিগুড়িতে এখন আবহাওয়া বড় আরামদায়ক। ছোটবেলায় হেমন্তকাল বলতে ধীমান যা বুঝত ঠিক তেমন। সকালে দশটা অবধি আর বিকেলে সাড়ে তিনটে থেকে একটা হালকা ঠান্ডার অনুভূতি টের পাওয়া যায়। রাতে সেটা বেড়ে গেলেও কাঁপুনি আসে না।যে ট্রেনিং-এর জন্য তাকে এখানে আসতে হয়েছে সেটার মেয়াদ মোটে দশ দিন। ধীমানের মনে হল আরও কিছুদিন হলেও মন্দ হত না। কলকাতায় এখনও বেশ গরম। মিতালি, মানে ওর বউ, গতকালই নাকি ফ্যান চালিয়ে রাতে ঘুমোতে গেছে।

মাঠের তিনদিকে তিনটে দল খেলছে। এক ধারে সাত-আটজন নেপালী ছেলের পায়ে ফুটবল। তারা উত্তরদিকটা দখল করে আছে। পূবকোণে পাঁচ-ছয়জন স্কুল পাঠরতা মেয়ে সিমেন্টের পিচে ক্রিকেট খেলছে। আর মাঠের মাঝখানের দখল নিয়েছে আট-দশটি ছেলে। তারা বেশ সিরিয়াস হয়ে এতক্ষণ ধরে ব্যাট-বল হাতে ব্যস্ত ছিল। শেষবেলায় তাদের জোশ কিছু পড়তির দিকে।তবু তারই মধ্যে চার-পাঁচজন অটুট অধ্যবসায় সহযোগে ব্যাটিং আর বোলিং প্র্যাকটিশ করছে। বুকের ভেতরের চাপা ধুকপুকুনিটা অনুভব করতে করতে ধীমান মনে করার চেষ্টা করল, কত বছর মাঠে নামেনি সে?

।। ২ ।।

যে দু’টি ছেলে পর্যায়ক্রমে বোলিং করছিল তাদের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল ধীমান। তার আগ্রহী মুখ দেখে সামনের পৌনে ছয় ফুট লম্বা ছেলেটি জানতে চায়, বল করবেন স্যার?

ধীমান যেন এরই অপেক্ষায় ছিল। সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে ছেলেটি তার দিকে খয়ে আসা ডিউজ বলটা ছুঁড়ে দিল।

লুফে নিয়ে এক ঝলক বলের দিকে তাকাতেই সে বুঝল একদিকের পালিশ উঠে গেছে। অন্যদিকটা যদিও সামান্য চকচকে। এরা নির্ঘাত রিভার্স সুইং করায়। আঙ্গুলগুলি দিয়ে পরম মমতায় বলটাকে আঁকড়ে ধরল সে। পারবে কি? এই ভারী চেহারা নিয়ে দৌড়নোর ঝুঁকিটা বরং না নেওয়াই ভাল। সে বাঁ-হাতি পেস বোলার ছিল।

ধীমান কয়েক পা এগিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করল। একজন ফর্সা, রোগা ছেলে স্টান্স নিয়ে তারই অপেক্ষায় প্রস্তুত। ধীমানের প্রথম টার্গেট হল কিছুতেই যেন সে ওয়াইড করে না বসে। থপথপ করে তার চার-পাঁচ পায়ের দৌড়ের শেষে কাঁধের ন্যূনতম ব্যবহার থেকে উদ্ভূত ডেলিভারিটি অফ-স্টাম্পের প্রায় আধহাত বাইরে দিয়ে বেরিয়ে গেল।

সেই ওয়াইড!

ধীমান লজ্জিত হয়ে ডান-হাত তুলে ‘সরি’ বলল।

ইটস ওকে স্যার। ক্যারি অন।

পেছন থেকে আরেকজন বলে উঠল।

ধীমান মাথা নিচু করে বল হাতে ফিরে এল। ইনসুইং-এর গ্রিপটা নিয়ে আবার সেই ডিবলি-ডবলি রান-আপের দৌড়। এবারেও ওয়াইড। তিন স্টাম্পের মধ্যে বলটা রাখতে সে প্রাণপণে চেষ্টা করেছিল। বলটা মিডল-স্টাম্পে পড়ে লেগস্টাম্পের বাইরে চলে গেল।

দু’টো বল করেই হাঁফাচ্ছিল সে। অনভ্যস্ত শরীর। বুকে অস্বস্তি। আর এগিয়ে লাভ নেই। সে একটু সরে এসে ওদের সুযোগ দিল। অল্পবয়স, মেদহীন গঠন, অভ্যস্ত হাত আর কাঁধ—দু’জনের বলেই জোর আছে। আলো আরেকটু কমে আসার মুহুর্তে ছেলে দু’টো ফের তাকে ডাকল। যেন পরেরদিন ম্যাচ  আছে এবং তারই ট্রায়াল চলছে! সুযোগ মিলবে?

আসুন না! আর কয়েকটা হয়ে যাক!

পৌনে ছ’ফুট ডাকছে।

এবারে যেন জেদ চেপে গেল ধীমানের।বছর পনেরো আগে শেষবার সে কোনও ম্যাচে নেমেছিল। এক উইকেটে সেদিন তারা হেরে যায়। শেষ ওভারে আট রান করলে জিতবে এমন অবস্থায় সে দলকে জেতাতে পারেনি। প্রথম বল করতে যাওয়ার আগে একটাই কথা ভেবেছিল। আট রান করতে দিলে ম্যাচটা হারবে। সাত হলে টাই। শেষ দুই বলে চার রান বাকি, এমতাবস্থায় ওভারের পঞ্চম বলে লেগ-বাই চার হয়ে ম্যাচটা হেরে যায় তারা। কিন্তু সেটাই কি হওয়ার কথা ছিল?

মনে করতে চাইল না ধীমান। বল হাতে যেন নতুন স্পেল শুরু করতে যাচ্ছে এমনভাবে রান-আপ নিল। আট পা দৌড়ত সে। ঠিক ওয়াসিম আক্রমের মতো। নিজেকে এভাবে বোঝাল সে—একটা ওভারই করবে। ব্যাটসম্যান যেন অন্তত একটিবার আউট হয়। নিদেনপক্ষে সে যেন পরাস্ত করতে পারে। কিন্তু এক নয়, ওরা তাকে আরও ছ’টি বল করতে দিল।ধীমান একটিবারের জন্যও নিজের মনের মতো লেন্থে বলকে ফেলতে পারল না। হয় অফস্টাম্পের অনেক বাইরে, কিংবা ফুলটস, অথবা লেগে ওভারপিচ নতুবা ওয়াইড। শেষ চেষ্টা করেছিল দিনের শেষ বলটায়। যদি ইয়র্কার বা ওই লেন্থের কাছে ফেলা যায়। ব্যাটসম্যান এক পা এগিয়ে এসে হাফ-ভলি বানিয়ে একস্ট্রা কভার ড্রাইভ করে দিল।

তুমি ফুরিয়ে গেছ ধীমান।

ঘরে ফিরতে ফিরতে অসীম বিরক্তিতে সে মনে মনে বলল।এই আনফিট শরীর নিয়ে আর যাইহোক ক্রিকেট হয় না।

।। ৩ ।।

কলকাতায় ফেরার পরে বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দেওয়ায় ছোটবেলার বন্ধু ডাক্তারের কাছে দেখাতে গেল ধীমান।

কী হয়েছে তোর?

ধীমানের বন্ধু সাত্যকি রায় জিজ্ঞেস করে।

বুক ধড়ফড়, সিঁড়ি ভাঙতে সমস্যা, রাতে ঘুমের ব্যাঘাত, বেশিক্ষণ দাঁড়ালে পা টনটন করা, সবসময় প্রচন্ড ক্লান্ত লাগা—অর্থাৎ যা যা হচ্ছিল সবই জানাল ধীমান।

সাত্যকি ভাল করে সব পরীক্ষা করে বলে, ওজন কমা। অন্তত আট থেকে দশ কেজি। তোর ওজন থাকার কথা বাহাত্তর। এখন কত?

ধীমান চিন্তিত গলায় বলল, চুরাশি।

সাত্যকি চোখ বড় করে বলে, ওরে বাবা! শোন, রোজ আধঘন্টা করে হয় মাঠে গিয়ে দৌড়ো অথবা জোরে হাঁট। এটাই তোর প্রথম ওষুধ। এছাড়া কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার যত পারিস ছেঁটে ফ্যাল। চায়ে চিনিটা বাদ দে। সপ্তাহে একদিন ভাত খা। একটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি। তবে এটা ওজন কমানোর জন্য নয়। এনার্জি বাড়াবার জন্য।

বিষণ্ণ মুখে বাড়ি ফেরার পরে মিতালি সব শুনে বলল, আমি তো কবে থেকে তোমাকে এই কথাগুলো বলে চলেছি! কানেই তোলো না। এবার?

ধীমান মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। এবার শুরু করব।

মুশকিলটা হল এই যে সকালে নিজেকে দেওয়ার মতো সময় তার থাকেই না। আর সন্ধ্যার মুখে এত ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরে যে তখন আর নিজেকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে না। তবু পরেরদিন সন্ধ্যায় ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আটটা নাগাদ হাঁটতে বেরোলো ধীমান। গন্তব্যও ভাবা ছিল। ভারতী সঙ্ঘের মাঠ। সেখানে এইরকম সময়ে তেমন ভিড় থাকে না। মাঠের চার ধারে দৌড়লেও হয়ত অসুবিধা হবেনা। একটা বাড়তি সুবিধা হল সন্ধ্যায় মাঠের দু’দিকে হ্যালোজেনের আলো জ্বলে। এটা অবশ্য বছরখানেক আগের কথা। বিয়েবাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে একদিন দেখেছিল ধীমান।

মিতালি তাকে বলেওছিল, এই দ্যাখো, কেমন সুন্দর মাঠ। তুমি তো চাইলে এখানে হাঁটতেও আসতে পারো।

তা পারি।

তবে কাল থেকেই আসা শুরু করো।

ধীমান তখনকার মতো ‘হ্যাঁ’ বললেও পরের তিনদিন অফিস থেকেই ফিরল রাত আটটার পরে। চতুর্থ দিন গেল অফিস ট্যুরে। সেই যে ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেল তো গেলই।

এদিন মাঠে হাঁটতে গিয়ে অবশ্য সে বেশ অবাক হল। মাঠের একধারে লাইট লাগিয়ে কোর্ট কেটে চারজন অল্পবয়সী মেয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছে। সান্ধ্য ভ্রমণকারীদের সংখ্যাও জনা পাঁচ-সাত হবে। আর ক্লাবঘরের সামনে সিমেন্টের পিচে নেটে ব্যাটিং করছে একটি ছেলে। উল্টোদিকে তিনজন বোলার। সকলেই বিশ-বাইশ বছর বয়সী হবে। তার মধ্যে একজনকে ও চেনে। ছেলেটার নাম বান্টি। বাঁ-হাতে ব্যাট করে। ধীমান যেখানে থাকে তার ক’টি বাড়ি পরেই ওদের বাড়ি। পুজোর চাঁদা চাইতে এসেছিল পরপর দু’বছর।

ধীমান মুহুর্তের দুর্বলতা কাটিয়ে মাঠের দক্ষিণমুখো হাঁটা শুরু করল।

।। ৪ ।।

মাস তিনেক পরের কথা।

ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে।শীত যাই-যাই করেও যাচ্ছে না।ধীমানের অফিসে ক’দিন কাজের চাপ কিছুটা কম। এমনিতেও তার শরীর এবং মন এখন অনেক হালকা।আর তার প্রথম কারণ গত তিন মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম। ধীমান হাঁটা থেকে দৌড় শুরু করেছিল এক সপ্তাহের মাথায়। আর তারও দু’সপ্তাহ বাদে ঘটনাটি ঘটল।

সেদিন প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ছুটোছুটি করার পরে ঘর্মাক্ত কলেবরে ধীমান সবে বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরতে চলেছে। এমন সময় হঠাৎ বান্টি একটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে হাজির।

ধীমুদা, একটু কথা ছিল। দু’মিনিট সময় হবে?

ধীমুদা!

ধীমান মনে করার চেষ্টা করছিল ‘ধীমু’ নামটায় তাকে বান্টির চেনার কারণটা কী হতে পারে! তার বাড়িতে বাবা-মা, আত্মীয়রা, খুব কাছের ক’জন বন্ধু ছাড়া আর কারও নামটা জানারই কথা নয়। ‘তুমি এই নামটা কেমন করে জানলে’—জিজ্ঞেস করার আগেই বান্টি পাশের রোগা ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল, আমার বন্ধু দীপজ্যোতি। ওর বাবাকে তুমি হয়ত চিনবে। দিগুকাকা। তোমাদের ভারতনগরের মানুষ।

ধীমান এক লহমায় দেড় দশক পিছিয়ে গেল। ভারতনগরের জীবনটা সে কবেই পেছনে ফেলে এসেছে।

ইয়ে—ওঁর নাম দিগেন অধিকারী। বান্টি যেন মনে করানোর চেষ্টা করল।

চিনি। বিবেক স্পোর্টিং ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

ধীমান সামান্য হেসে বলল।  

অতর্কিতে একটা অন্য স্মৃতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল। দ্রুত সেটাকে দাবিয়ে দিয়ে সে জানতে চাইল, কেমন আছেন উনি? অনেক বছর হল কোনও যোগাযোগ নেই।

দীপজ্যোতি হেসে বলল, চলছে একরকম। বয়স বাড়ায় মোবিলিটিটা একটু কমেছে।

ক্লাবে নিয়মিত যান?

যান। নিয়মিত নয়।

বান্টি বলল, ও আর আমি একই কলেজে পড়ি। একদিন কথা প্রসঙ্গে বলল, তোদের ওখানে আমাদের ভারতনগরের একজন পরিচিত মানুষ থাকেন। ধীমান মিত্র। একসময় ডিস্ট্রিক্ট লিগে ভাল ক্রিকেট খেলতেন।

তোমার কথাই যে বলছে সেটা বুঝে গেলাম। গতকাল ও আমাদের বাড়িতে এসেছিল। ক’দিন ধরেই তোমাকে মাঠে আসতে দেখছি। সেটা ওকে বলায় তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চাইল। তাই ভাবলাম—

দীপজ্যোতি বলল, আপনি আর আমাদের ওদিকে এখন যান না, বোধহয়—

ধীমান হেসে বলল,খুব কম। শেষবার গিয়েছিলাম বছর তিনেক আগে।

পরেরবার গেলে আমাদের বাড়িতে আসবেন কিন্তু।

যাব। যদিও সেটা কবে পারব জানি না।

আচ্ছা। আমিই আপনাকে জানাব।

ধীমান স্মিত হাসল।

কে জানত, যাওয়ার লগ্ন এত দ্রুত আসবে!

।। ৫ ।।

আসলে ধীমান যে নিয়মিত খেলত এটা জানার পরে বান্টিই অফারটা দিয়েছিল।

নেটে এসো না ধীমুদা! আমরা তো অনেক রাত অবধি এখানে প্র্যাকটিশ করি।

ধীমান বলেছিল, না গো! বয়স হয়ে গেছে। তায় এই ভারী চেহারা। এখন আর এসব হয় নাকি!

কেন হয় না? কী আর এমন বয়স তোমার! দেখোই না, এসে!

ধীমান এড়াবার চেষ্টা করে বলল, তাছাড়া আমি তো তোমাদের ক্লাবের মেম্বারও নই। এমনি এমনি গেলে সেটা ভাল দেখায় না। কেউ হয়ত আপত্তি করবেন।

এটা কোনও কথা হল! আমি কালই চম্পকদাকে বলছি।

চম্পকদা কে?

আগে আমাদের কোচিং করাতেন। এখন ক্লাবের সেক্রেটারি। খুব ভাল মানুষ। তুমি কথা বলে দেখো।

ধীমান আর কথা বাড়ায়নি, যদিও বান্টি ওর পেছনে পড়েই ছিল। ধীমানকে নেটে ডেকে আনতে ওর আর দিন দুয়েক সময় লাগল। সেটা নভেম্বরের শেষ শনিবারের সন্ধ্যা। অল্প নয়, তখন ঠান্ডা আরেকটু বেশি। ধীমান দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিমায় বল হাতে গুনে গুনে আট পা রান-আপ নিল। প্রথম তিনটে বলে ওর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। শিলিগুড়ির মতো এখানেও সবক’টা ওয়াইড হওয়ার পরে চতুর্থ বলটা অবশেষে গুড-লেন্থে পড়ল। বান্টিই ব্যাট করছিল। ফ্রন্ট-ফুটে ডিফেন্স করে চেঁচিয়ে বলল, ওয়েল বোল্ড।

তারপরের বলটাও প্রায় একই জায়গায় এল। কিন্তু গতিটা সামান্য বেশি। লেট আউটসুইং করে বান্টির ব্যাটের ধার ঘেঁষে চলে গেল।

পরম পুলকে ধীমান ভেতরে ভেতরে শিউরে ওঠে। পারছে সে! এই প্রায় মধ্য চল্লিশে এসেও বলকে দিয়ে সামান্য কথা বলাতে পারছে। শিলিগুড়িতে তবে কী হয়েছিল তার?

ধীমান পরের দুই মাসে ভারতী সঙ্ঘ ক্লাবের নেটে নিয়মিত বোলিং করতে শুরু করল।

মিতালি স্বস্তি পেয়েছিল এই ভেবে যে অন্তত এবারে ধীমানের ফিটনেস বাড়বে, ওজন কমবে আর কাজেও আরেকটু মন বসবে। ধীমানেরও এর চেয়ে বেশি কিছু চাইবার ছিল না। নেশার মতো সে সন্ধ্যেটা নেটে কাটাত। এমনকি ডিসেম্বরের শীতেও। আর এখন তো প্রায় বসন্তকালীন আবহাওয়া এসে গেল। সেদিন নেটে গিয়ে ধীমান আবিস্কার করল দীপজ্যোতি এসেছে।

তাকে দেখতে পেয়ে দীপজ্যোতি এগিয়ে এসে বলল, ধীমুদা,একটু কথা ছিল যে!

কী ব্যাপারে?

বিবেক সঙ্ঘের গোল্ডেন জুবিলি এই বছর। আমাদের অবশ্য আর্থিক ক্ষমতা সামান্যই। তবু তারই মধ্যে যেটুকু জাঁকজমক করা যায়।

বেশ তো। কী করতে পারি বলো?

একটা এক্সিবিশন ম্যাচ আয়োজন করছি। বিবেক স্পোর্টিং বনাম ভারতী সঙ্ঘ। আগামী রবিবার। আপনাকে আমাদের দলের হয়ে নামতে হবে। বাবা বিশেষ করে বলে দিয়েছেন।

সেরেছে! এইটা তো ভাই পেরে উঠব না!

কেন বলুন তো? আপনি এখানে নেটে দিব্যি বোলিং করছেন। একসময় নিয়মিত ডিস্ট্রিক্ট লিগ খেলতেন। আপনি ভারতনগরের মানুষ। খেলব না বললে চলে?

ঘোরতর সমস্যায় পড়ে গেল ধীমান। আমতা-আমতা করে বলল, এটা হয় না।আমি শখে নেটে আসি। তার মানেই ম্যাচ খেলতে পারব এমন নয়। আর যেটুকু ফিটনেস ফিরে পেয়েছি সেটা এঁদেরই  দৌলতে। মাঠে কী করে উল্টোদিকে নামি? তুমি ভাই আমাকে এমন অনুরোধ কোরো না।

ধীমান প্রবল অস্বস্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। মিতালি সব শুনে বলল, কোনও পক্ষেই তোমার থাকার দরকার নেই। তার থেকে চলো সামনের উইকেন্ডে কোথাও বেড়িয়ে আসি।

ধীমান গম্ভীর মুখ করে বসে রইল। যত সব উটকো ঝামেলা। কেন যে সে ভারতী সঙ্ঘের মাঠে গিয়েছিল! ভারতনগরে তার ছোট থেকে বড়বেলা সবটাই কেটেছে। বেশ কিছু বছর আগে সেখানকার পাঠ চুকিয়ে দিয়ে বেলগাছিয়ায় তারা উঠে এলেও একেবারে সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে, এমন নয়! ধীমানের বাবা তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ করেন বা ফোনে কথা বলে থাকেন। তিনি শুনলে ব্যাপারটা কীভাবে নেবেন? আবার বিবেক স্পোর্টিং-এর হয়ে নামলে বান্টিরাই বা কী ভাববে? এক অদ্ভুত টানাপড়েনে জড়িয়ে গেছে ধীমান। আর সেটা বাড়ল ক’দিন বাদেই। বান্টিকে সে আলাদাভাবে ডেকে বলে দিয়েছিল যে তাকে যেন দলে রাখা না হয়। তার কারণ চম্পকদা ধীমানের ব্যাকগ্রাউন্ড জানার পরে তাকেই নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ধীমান ‘না’ বলায় বান্টি নিরুপায় হয়ে সেদিন মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিল। ম্যাচের আগের রাতে সে হঠাৎ ধীমানের ফ্ল্যাটে এসে হাজির হল।

ধীমুদা, কাল মাঠে নামো, প্লিজ।

আবার কী হল?

প্রকাশ আর রাজদীপ কাল থাকছে না। দু’জন স্ট্রাইক বোলার।

কেন? কী হয়েছে?

প্র্যাকটিশে এসে প্রকাশের অ্যাংকল টুইস্ট করেছে। ছুটতে পারছে না। ওদিকে রাজদীপ ফ্লুয়ে কাবু। বিছানায় পড়ে আছে। টিম হচ্ছে না দাদা। এগারোটা প্লেয়ার তো চাই। আমি ক্যাপ্টেন। তুমি ছাড়া আর কাকে এখন বলব?

অসম্ভব। তোমরা কাউকে ভাড়া করে নিয়ে যাও।

চম্পকদা তাতে রাজি নন। তিনি তোমার কথাই—

একটা ফোন এসেছে। ধীমানের মোবাইলে। চম্পকদাই।

ফোনটা রিসিভ করার পরে তিনি বললেন, ভাই ধীমান। রাজি হয়ে যেও। অন্য উপায় থাকলে এভাবে বলতাম না। প্লিজ—

।। ৬ ।।

বিবেক স্পোর্টিং-এ ম্যাচটা শুরু দুপুর দেড়টায়। ধীমান বহুদিন বাদে ছোটবেলার স্মৃতিঘেরা মফস্বল শহরে এসে ট্রেন থেকে নামল। কত দোকানপাট বেড়ে গেছে এই ক’বছরে। চারপাশ কেমন যেন বদলে গেছে। তাদের বাড়িটা যেখানে ছিল সেই পাড়াটাও কি—?

ধীমান আর ভাবতে চাইল না।

বেরোবার আগে সব কথা শুনে বাবা বললেন, বড় মায়া রে ধীমু! খেলে আয়। কেউ না কেউ তো জিতবে!

ধীমান মনে মনে বলল, আজ কিছুতেই হারব না। কিন্তু জিতেও কি আনন্দ হবে? 

দীপজ্যোতির সঙ্গে সে বিপক্ষ শিবিরের ক্লাবঘরে গিয়ে দিগেন অধিকারীর মুখোমুখি হল। সত্তরোর্ধ ভদ্রলোকের স্বাস্থ্য এখনও খুব ভেঙে পড়েনি। সাড়ে পাঁচ ফুটের শরীর কেবল সামান্য ঝুঁকে পড়েছে।

ওর হাত দু’টো ধরে তিনি বললেন, সেই তুই এলি! আমাদের হলি না!

ধীমান জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন আপনি?

ভালই আছি। অতীত ভুলে গেছিস, বেশ করেছিস। যাওয়ার আগে আরেকবার আসিস।

ধীমান কি সত্যিই সব ভুলে গেছে? ভোলা সম্ভব?

কথাগুলো ভেতরে ধাক্কা মারার মুহুর্তে সে কোনওমতে ‘আসব’ বলে একরকম পালিয়ে এল।

টসে হেরে ভারতী সঙ্ঘই আগে ব্যাট করতে নেমেছিল। কুড়ি ওভারের ম্যাচ। বান্টি, রূপ আর সুজিতের সহায়তায় মোটে একশো চল্লিশ রানের টার্গেট দিতে পেরেছিল তারা। যদিও ধীমান যখন এগারো নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে এক রান করে বোল্ড হল তখনও শেষ ওভারের চারটি বল বাকি!

বিবেক স্পোর্টিং-এর দুই ওপেনার বাবুলাল আর স্বাধীন, ভারতী সঙ্ঘের ওপেনিং বোলার জিষ্ণু এবং রাজেশকে মনের সুখে পিটিয়ে প্রথম চার ওভারে প্রায় চল্লিশ রান তুলে দিল। মাঠের চারধারে স্থানীয় মানুষদের উল্লাস তখন আর দেখে কে! ধীমানের দিগুকাকার চোখ-মুখ চকচক করছিল। এমনকি সুজিত আর রূপ যখন বল করতে এল তখনও শুরুতে সমস্যা হয়নি। ধীমানকে তার আগে বল করার জন্য বান্টি ডেকেছিল। কিন্তু ধীমান, জিষ্ণু আর রাজেশের অবস্থা দেখে ভরসা পাচ্ছিল না। অষ্টম ওভারে প্রথম উইকেট পড়ল বিবেক সঙ্ঘের। স্বাধীন অহেতুক একটা দু’রানের জন্য দৌড়তে গিয়ে রান আউট হল। ফাইন লেগ থেকে রূপ সোজা উইকেটকিপার প্রীতমের গ্লাভসে বল পাঠিয়ে দিয়েছে। আর ঠিক তারপরেই বান্টি ধীমানকে ডাকল। নতুন ব্যাটসম্যান নেমেছে—ভাস্বর। ধীমানের প্রথম বলটা যথারীতি ওয়াইড হল। পরের বল কোমরের ওপর দিয়ে যাওয়ার জন্য  আম্পায়ার নো ডাকলেন। কিন্তু তিনটে বল পরে ভাস্বর প্রীতমের ডান-হাতের পাশ দিয়ে স্টিয়ার করতে গিয়ে ধরা পড়ল। দুই উইকেটে তেষট্টি থেকে বারো ওভারে আটাত্তরে ম্যাচটাকে আনার জন্য অবশ্য জিষ্ণুর দ্বিতীয় স্পেল আর সুজিতের দু’টো ওভারের কথাও বলা দরকার। কারণ ধীমানকে এক ওভার বল করিয়ে তুলে নিয়েছিল বান্টি।

ধীমানের বেশ মজা লাগছিল চারপাশ দেখে। এত দর্শক এসেছেন ম্যাচটি দেখতে! নিজেকে বেশ ‘স্টার’ খেলোয়াড় মনে হচ্ছিল তার। বেলা পড়ে আসছে। আট ওভারে বাষট্টি রান করলে জিতবে এখান থেকে বিবেক সঙ্ঘ ম্যাচটা ফের ধরে নিল। হাতে সাত উইকেট আছে। নয়ন ওদের দলের ওজনদার ব্যাটসম্যান। তার সঙ্গে কনক খেলছে।

ওদিকে দীপজ্যোতি ব্যস্ত ছিল ম্যাচের পরে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে। দিগুবাবু, দীপজ্যোতিকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। পুরস্কার বিতরণের মঞ্চে কারা থাকবেন, তারপরে উপহারসামগ্রীর বিলি-বন্দোবস্ত কীভাবে হবে। কাজ কি কম?

বান্টি দু’ওভার পরেই ধীমান আর রাজেশকে ফিরিয়ে আনল। বান্টি জানে আগামী দশ মিনিটে যদি উইকেট না পড়ে তাহলে ম্যাচটা হাত থেকে বেরিয়ে যাবে। ধীমান ভাবছিল পনেরো বছর আগের কথা। এই মাঠেই তো খেলাটা হয়েছিল! নবারুণ স্পোর্টিং-এর হয়ে সেদিন নেমেছিল সে। বিপক্ষে বিবেক সঙ্ঘই!

ধীমান বোলিং রান-আপের মাথায় এসে ফিল্ডিংটা আরেকবার সাজিয়ে নিল। প্রথম দু’বলে একটি করে রান আসার পরের বলটি রূপ কভারে দাঁড়িয়ে আটকে দিয়েছে। কিন্তু লাভ হল না। কারণ চতুর্থ বলটি ব্যাটসম্যান গ্লান্স করে ফাইন লেগ বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে দিল। 

ওদিকে ধীমান পঞ্চম বলটা কনকের পায়ের কাছে ফেলতে চাইছিল। লেন্থের সামান্য ভুলে সেটা হয়ে গেল লো-ফুলটস! লোভাতুর কনকের অন-ড্রাইভ মিড-উইকেটে দাঁড়ানো বান্টির মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে দেখে নিখুঁত সময়জ্ঞানে বান্টি স্পটজাম্প দিল। হতবাক হয়ে কনক দেখল ডানহাতে বলটা আঁকড়ে ভল্ট খেয়ে জমি থেকে বান্টি উঠছে। মাঠে যেন তখন পিন-পতনের স্তব্ধতা।

নতুন ব্যাটসম্যান কৌস্তভ এসে প্রথম বলেই স্ট্রেট-ড্রাইভ করেছিল। ধীমান ফলো-থ্রুতে হাতটা ছোঁয়াবার ন্যানো সেকেন্ড বাদে আবিস্কার করল নয়ন ক্রিজের বাইরে আর বলটা সোজা গিয়ে রানার্স এন্ডের উইকেটটা ভেঙে দিয়েছে।

সাত ওভারে ছাপ্পান্ন বাকি। চলো সবাই। হারার আগে হারছি না।

বান্টি পরের ওভারটা শুরুর আগে হাডল করে ঘোষণা করল।

কিন্তু নতুন দুই ব্যাটসম্যান, দেবার্ঘ আর মিহির অন্যরকম ভেবেছিল। নাহলে পরের চার ওভারে বত্রিশ রান ওঠে?

বলেছিলাম না! এত সোজা নয় রে! আমার পাড়ায় এসে আমাকেই মেরে বেরিয়ে যাবি! যতই কলকাতার টিম হোক না কেন, আমার ছেলেগুলো কি অতই ফালতু!

দিগুবাবু ক্লাবের ট্রেজারার অমরের দিকে তাকিয়ে আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন।

কিন্তু দিগুদা ধীমুর একটা ওভার—

অমর বলতে গিয়েও মাঝপথে থেমে গেল।

জানি। সাধে ব্যাটাকে দলে টানতে চেয়েছিলাম? এলে এতক্ষণে—

দিগুবাবু চাপা টেনশনে মাঠের পূবকোণের বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়ানো ধীমুকে জরিপ করছিলেন।

।। ৭ ।।

বান্টি জিষ্ণু আর রাজেশের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ধীমুদাকে দিয়ে করিয়ে নিই? কী বলিস তোরা? নাকি রেখে দেব?

ধীমান, সুজিত আর রূপের একটি করেই ওভার হাতে আছে। জিষ্ণু আর রাজেশের কোটা শেষ। তিন ওভারে চব্বিশ রান চাই।

রাজেশ বলল, অন্তত এই ওভারটা দিস না। তেমন হলে পরেরটায় ডাক।

জিষ্ণু বলল, এক্সাক্টলি। সুজিত বা রূপকে ডাক।

কী ভেবে বান্টি রূপকেই ডেকে নিল। ওদের ভাগ্য ভাল যে রূপ সাত রানের বেশি দিল না। এবার? ধীমান না সুজিত?

বান্টির দোটানা যখন চরমসীমায় সেই মুহুর্তে সুজিত বলল, আমিই যাচ্ছি। শেষ ওভারটা চাপ হয়ে যাবে। ভাবিস না। ডোবাব না।

মিনিট পাঁচেক বাদে সুজিত বান্টির দিকে তাকাতে পারছিল না। প্রথম বলে দেবার্ঘ ছয় মারতে গিয়ে লং-অফে ধরা পড়লেও মিহির উল্টোদিকে চলে গিয়েছিল। ফলত শোধটা সে ভালমতোই তুলে নিল। থার্ডম্যান, ফাইন লেগ, ডিপ মিড উইকেট আর বোলারের মাথার ওপর দিয়ে পরপর চার বলে দু’টি করে রান নিয়ে শেষ বলে সিংগল চুরি করল সে।

ধীমান যখন শেষ ওভার করতে যাচ্ছে তখন মাঠে বিবেক স্পোর্টিং-এর সমর্থকরা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছিল। দু’টি বাউন্ডারি হলেই কেল্লা-ফতে।

মিহিরের জন্য সে মূলতঃ ইয়র্কার আর স্লোয়ার বাউন্সার বরাদ্দ রেখেছে। পনেরো বছর আগের স্ট্র্যাটেজি। আজও তার মনে হয় যে সেদিন সে কিছু ভুল করেনি। সেবারে বিপক্ষ জিতে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা কি দৈবাৎ? লেগ-বাই বাউন্ডারি তো পরের কথা। বলটা পায়ে লাগার জন্য তার আগে এলবির অ্যাপিলটা? আম্পায়ার কানু মাইতি যেটা দেয়নি? টাকা খেয়ে কি? কে খাইয়েছিলেন? দিগুবাবু?

আঠাশ বছরের ধীমান সেদিনের পরে আর মাঠে নামেনি। সেই জ্বালা কি তবে আজ মিটবে?

প্রথম দু’টো বলে মিহিরের ড্রাইভ শর্ট কভার আর শর্ট মিড উইকেটে দাঁড়ানো ফিল্ডারের হাতে আটকে গেল। পরের বলে অবশ্য স্টেপ-আউট করে একস্ট্রা কভারের পেছনে ফেলে দু’রান পেল সে। উত্তেজনায় থরথর করে যেন কাঁপছিল গোটা মাঠ। অচঞ্চল ধীমান বান্টিকে হাত তুলে ভরসা দিল—ভাবিস না। চতুর্থ বলটা অফ-মিডলে স্লোয়ার ছিল। মিহির ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের বাঁদিকে স্ল্যাশ করল। সোজা বাউন্ডারি।

এবার? হাতে দু’টি বল। বাকি দু’টি রান। ধীমানের ফ্ল্যাশ-ব্যাকে পনেরো বছর আগের বিকেলটা ফিরে আসছে। পঞ্চম বলটা মিহিরের পায়ের গোড়ায় ধেয়ে এল। সে কোনও মতে ফাইন লেগের দিকে ফ্লিক করার চেষ্টা করে একটি রানের জন্য দৌড়েছে। স্কোর লেভেল।

বান্টি ছুটে এল এবার।

ধীমুদা, সবাইকে সার্কলে নিয়ে আসি। আর তো উপায় নেই।

ধীমান এখনও ভাবতে পারছে না যে ম্যাচটা জেতা গেল না।

কোনওমতে সে ঘাড় নাড়ল।

এইরকম মুহুর্তে মানুষ বোধশূন্য হয়ে যায় কি? ধীমানের মাথাটা কেমন যেন ফাঁকা লাগছিল। ক্লান্ত বোধ করছিল সে।

শরীরের সব শক্তি সঞ্চয় করে শেষ বলের জন্য সে নিজেকে ছুটিয়ে নিয়ে চলল। ক্রশ সিমে বলটা ধরে হাতের পেছন দিয়ে অফ-স্টাম্পের সামান্য বাইরে ফেলেছিল। উইকেটকিপার বিপ্লব ‘নাকল’ বলটা বুঝতে না পেরে আগেভাগে ব্যাট চালিয়েছে। প্রত্যাশার থেকে অনেক আস্তে বল এসে ব্যাটের ওপরের দিকে লেগে উঁচু হয়ে ধীমানের ডানদিক দিয়ে যাওয়ার মুহুর্তে সে নিজেকে সেদিকে ছুঁড়ে ডানহাতটা পেতে দিল।

নাহ! ক্যাচ সে ধরেনি। বরং বলটাই তার তালুতে জমে গেছে।

দিগুবাবুর ভাষাহীন চোখের দিকে দীপজ্যোতি তাকিয়ে ছিল! এভাবেও ম্যাচটা হাতছাড়া হতে পারে!

বাড়ি ফেরার পরে ধীমান বাবার সামনে এসে দাঁড়াল।

ততক্ষণে তাকে নিয়ে বান্টিদের একপ্রস্থ উল্লাস শেষ হয়েছে। মিতালিকে তারা তখন ম্যাচ রিপোর্ট দিতে ব্যস্ত।

ধীমান বাবাকে বলল, পেরেছি বাবা।

কী পেরেছিস?

নিজেকে দেওয়া কথা রাখতে পেরেছি।

কী কথা দিয়েছিলি?

অনেকদিন পরে ধীমানের চোখ জলে ভরে এল।

বাবা বললেন, থাক। বুঝে গেছি রে! ওয়েল প্লেইড ধীমু!

ছবি: রাহুল মজুমদার
‘জানুয়ারি ২০২০, বইমেলা সংখ্যা’ থেকে গৃহীত।