বিদায় উড়ন্ত শিখ

বল বয়

Posted On: June 25, 2021

বিশ্বজোড়া মারণ রোগ রেহাই দিলনা উড়ন্ত শিখকেও। গত আঠেরোই জুন চণ্ডিগড়ে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন ভারতের সেরা অলিম্পিয়ান মিলখা সিং, যাকে তামাম ভারতবাসী চেনে উড়ন্ত শিখ নামে। তিন তিনটি অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন মিলখা, কোনো মেডেল তিনি পাননি। কিন্তু রোম অলিম্পিকে তাঁর সেই অবিশ্বাস্য দৌড়ের দৌলতে তাঁকে সেরা অলিম্পিয়ান আখ্যা দিলে মনে হয় কেউ আপত্তি করবেনা।

১৯৬০-এ রোম অলিম্পিকের সময়ে মিলখা ছিলেন তাঁর সেরা ফর্মে। অলিম্পিকের আগে ইওরোপে বেশ কিছু প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আমেরিকার ওটিস ডেভিস ছাড়া সেই সময়ের বিশ্বের সব সেরাদেরই তিনি পরাজিত করেছিলেন। তাই মিলখার অন্তত একটি অলিম্পিক পদক জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল ভারতবাসী। প্রথমে ঠিক ছিল অলিম্পিকে মিলখা ২০০ এবং ৪০০ মিটারে অংশ নেবেন। কিন্ত শর্ট স্প্রিন্টে মাসল পুল হবার আশংকায় কোচ ২০০ মিটার থেকে মিলখার নাম প্রত্যাহার করে নেন। সিদ্ধান্তটা হয়তো সঠিক ছিলনা, কারণ পরে দেখা গেছে ২০০ মিটারের প্র্যাকটিসে মিলখার সময়ের সঙ্গে পদকজয়ীদের ফারাক নগন্য।

৪০০ মিটার দৌড়ের ফাইনালে পোঁছতে হিটের তিনটি রাউণ্ডের বাধা টপকাতে হয়েছিল মিলখাকে। ফাইনালে আড়াইশো মিটার পর্যন্ত সবার আগে ছিলেন মিলখা। কিন্তু ওই সময়েই ঘাড় ঘুরিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের অবস্থান দেখতে গিয়েই মারাত্মক ভুল করে ফেলেন তিনি। এক মুহূর্তের মিলখার সেই মনোসংযোগের ব্যাঘাতের সুযোগ নিয়ে তাঁকে অতিক্রম করে গোল্ড, সিলভার আর ব্রোঞ্জ মেডেলের অধিকারী হয়ে যান যথাক্রমে আমেরিকার ওটিস ডেভিস, জার্মানীর কার্ল কাউফম্যান ও দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যালকম স্পেন্স। ম্যালকমের সঙ্গে মিলখার সময়ের তফাৎ ছিল ০.১ সেকেণ্ডের। 

“সকাল দেখেই বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে”— মিলখার শৈশব বা কৈশোর জীবনের ওপর চোখ ফেললে কখনোই এই প্রবাদ বাক্যটির সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাবেনা। দেশভাগের দাঙ্গায় বাবা, মা সহ পরিবারের অনেককেই হারিয়েছেন। শরনার্থী হয়ে এসেছেন দিল্লীতে। প্রচণ্ড কষ্টে কেটেছে সেই দিনগুলি। বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণের জেরে জেল খেটেছেন দিন কুড়ি। সেই সময় বন্ধুত্ব হয়েছে চোর, ডাকাত, খুনিদের সঙ্গে। জেলমুক্তির পরবর্তী সময়ে খুবই সম্ভাবনা ছিল বিপথে যাবার। সৌভাগ্যক্রমে সেই সময় দাদার সুপারিশে তিনি সেনা বাহিনীতে যোগ দিলেন। সেখানেও জীবন চলছিল গতানুগতিক। মোড় ঘুরল ১৯৫৩ সালে। সেনাবাহিনীতে দৌড়বীর অনুসন্ধানের জন্য একটি দূরপাল্লার দৌড়ের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে যোগ দিয়ে নির্বাচিত হলেন মিলখা। এর আগে অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গে কোনোই সম্পর্ক ছিল না মিলখার। এবার শুরু হল সঠিকভাবে কঠোর অনুশীলন। নানান প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করে কয়েক বছরের মধ্যেই ভারতের শ্রেষ্ঠ দৌড়বীরের আসনটি দখল করে নিলেন মিলখা সিং।

১৯৫৬-এর অলিম্পিকে অংশ নিলেও হিটের বেড়া টপকাতে পারননি মিলখা। ১৯৫৮-এর এশিয়ান গেমসে ২০০ এবং ৪০০ মিটারে এবং ১৯৬২-এর এশিয়ান গেমসের ৪০০ মিটারে সোনা জিতেছিলেন তিনি। এছাড়াও ১৯৫৮-এর কমনওয়েলথ গেমসেও একটি সোনা জিতেছিলেন তিনি, সেটি ছিল ৪৪০ গজের দৌড়ে। ভারতীয়দের মধ্যে তাঁর দৌড়ের রেকর্ড অক্ষুন্ন ছিল বহু বছর। ১৯৬০-এ পাকিস্তানে একটি আমন্ত্রণী প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন মিলখা। প্রতিযোগিতার শেষে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল আয়ুব খান তাঁকে ‘উড়ন্ত শিখ’ বলে সম্বোধন করেছিলেন, যে নামটি পরবর্তী দিনে তাঁর আসল পরিচয় হয়ে উঠেছিল। 

অলিম্পিক ও ভারত, এই শিরোনামে কোনো আলোচনা হলে অবধারিত ভাবে মুখ্য বিষয় হবে হকি। অলিম্পিকের পুরুষ হকি বিভাগে এক সময় একছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিল ভারতীয় হকি দল। ১৯২৮ থেকে ১৯৮০, এই সময়ে ভারত হকিতে মোট আটবার জিতে নিয়েছিল সোনা। এছাড়া এই সময়ে তাদের ঝুলিতে রয়েছে একটি রূপো ও দুটি ব্রোঞ্জ। কিন্তু ব্যক্তিগত বিভাগে ভারতীয় খেলোয়াড়রা একসময় শুধুমাত্র অংশগ্রহণেই সন্তুষ্ট থাকতেন। ১৯০০-এর প্যারিস অলিম্পিকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অংশ নিয়ে নরম্যান প্রিচার্ড অ্যাথলেটিকসে দুটি রৌপ্য পদক জিতেছিলেন। পরের একশো বছরের বেশী সময়ে অ্যাথলেটিকসে ভারতের ভাড়ার শূণ্য। মিলখা ছাড়া হিটের বেড়া টপকে বিভিন্ন আলম্পিকে ফাইনাল রাউণ্ড অবধি পৌঁছেছিলেন মাত্র জনা চারেক অ্যাথলিট— গুরবচন সিং রনধাওয়া, শ্রীরাম সিং, পি টি উষা ও অঞ্জু ববি জর্জ। অন্য বিভাগগুলিতেও প্রায় পুরো শতাব্দী জুড়েই  ১৯৫২-এর হেলসিংকি অলিম্পিকে কুস্তিতে কে ডি যাদবের ব্রোঞ্জ মেডেল ছাড়া ছিল না আর কোনো সাফল্য। শতাব্দীর অন্তিম লগ্নে এসে সেই গাঁঠটা ছাড়িয়েছিলেন লিয়েণ্ডার পেজ। ১৯৯৬-এর আটলান্টা অলিম্পিকে টেনিসে পেজের ব্রোঞ্জ মেডেল জয়ের পরবর্তী অলিম্পিকগুলিতে ভারতকে আর খালি হাতে ফিরতে হয়নি। সেই মেডেলগুলির সাফল্য মিলখাকে খুশি করার পাশাপাশি হৃদয়টাকে রক্তাক্তও করত। কারণ ওই মেডেলগুলির একটাও আসেনি অ্যাথলেটিকস থেকে। টেনিস, ভারত্তোলন, শুটিং, কুস্তি, বক্সিং, ব্যাডমিন্টনে ভারতের ছেলে মেয়েরা পদক পেয়েছে, কিন্তু সেই তালিকায় নাম ওঠেনি কোনো ভারতীয় অ্যাথলিটের। কয়েক বছর আগে মিলখা বলেছিলেন তিনি চোখ বোজার আগে দেখে যেতে চান অলিম্পিকের ভিক্ট্রি স্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ভারতীয় অ্যাথলিটকে। আর এক মাস পরেই শুরু হবে টোকিও অলিম্পিক। ভারতীয় দলে অ্যাথলেটিক্স বিভাগে আছেন প্রায় ডজন খানেক প্রতিযোগী। নীরজ চোপরা, অভিনাশ সিবল, মুরলি শ্রীসেখরনরা বিশ্বসেরাদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দিতায় মাঠে নামবেন। জ্যাভলিন থ্রো-তে নীরজের পদক প্রাপ্তির ব্যাপারে অনেকেই আশাবাদী। অন্য প্রতিযোগিদের জন্যও রইল আমাদের শুভেচ্ছা।

এখন দেখার পালা, মিলখা সিং-এর অপূর্ণ ইচ্ছাটি কি এবার পূরণ হবে?

ফোটো- ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত

Tagged with: , , ,