কমলিনী

মৌসুমী দেব ঘোষ

Posted On: June 20, 2021

।।১।।

নিচের তলা থেকে ভেসে আসছে কমলিনীর হাসির শব্দ, বলা ভালো অট্টহাসির শব্দ, আসলে মেয়েটা চিরকাল এমন করেই হাসে, উচ্চগ্রামে। তাতে কারো কোন আপত্তি ছিল না, সবাই তো ওকে ভালোই বাসে। ওর মতো মিষ্টি চুলবুলি একটা মেয়েকে ভালো না বেসে কেউ থাকতে পারে! কিন্তু এবছর ব্যাপারটা আলাদা একদমই, সবাই তাই নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। প্রত্যেকের চোখেই অবাক হবার ইশারা, কমলিনী ঠিক আছে তো?

আজ সকাল থেকেই এবাড়ির সবাই খুব ব্যস্ত। আত্মীয়স্বজনের আনাগোনায় সরগরম গোটা মিত্ররায় বাড়ি, আজ যে বাড়ির কর্তার মৃত্যুবার্ষিকী। প্রতিবছরের মত এবারও সব আয়োজনই হয়েছে। সুন্দর করে ফুল মালা দিয়ে সাজানো হয়েছে তাঁর ছবিটা, ধূপধুনোর গন্ধে সারা বাড়িটা ভরে গেছে। কাজের লোকেদের আজ দম ফেলার ফুরসৎ নেই, কে চা পেল না, কার কাছে জলখাবার পৌঁছল না,  কর্তামার সব দিকে কড়া নজর। অন্যদিন তিনি খুব একটা নিচে নামেন না, কিন্তু এই দিন তিনি সকাল সকাল স্নান সেরে গরদের শাড়ি পড়ে ঠিক পূজার জায়গায় এসে বসেন। আজকাল করতে তেমন কিছু পারেন না, কিন্তু চেয়ারে বসে বসেই সব দিকে খেয়াল রাখেন। এবছরও তার অন্যথা হয়নি। কমলিনীর হাসির শব্দ অন্যদের মত তাঁকেও একটু অবাক করেছে বইকি।    

প্রতিবছর এই দিনটিতে ওরা সবাই এক জায়গায় মিলিত হয়, ওদের বাপের বাড়িতে। ওরা মানে কমলিনীর মা-মাসিরা। ওর দাদুর মৃত্যুবার্ষিকীটা এখন ওদের বাৎসরিক মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। যে যেখানেই থাকুক না কেন, চেষ্টা করে অন্তত বছরের এই দিনটায় সবাই খড়গপুরের দাদানের বানানো সাবেকী বাড়িতে আসতে, দিদার পাশে থাকতে। দিদার বয়েস হয়েছে ভালোই, আশি তো হবেই। কিন্তু বেশ শক্ত আছেন এখনো। তিন মেয়ে আর তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাঁর ভরপুর সংসার।    

একটা বেশ ফ্যামিলি গেট-টুগেদারের মতো হয়, দিনটা এখন আর শোকের নেই। কমলিনির দাদু তো গতই হয়েছেন প্রায় কুড়ি বছর হতে চলল। সকালের দিকে ঠাকুরমশাই নিয়ম মত কাজকর্ম করে যান। তারপর সবাই মিলে সারাদিন দেদার আড্ডা, অফুরন্ত খাওয়া দাওয়া, গান-গল্প, হইচই। সারাটা দিন কোথা দিয়ে যে কেটে যায় বোঝাই যায় না। পরেরদিন আবার যে যার জায়গায় ফিরে যায়। কমলিনী ওর দিম্মা সতীদেবীর বড় মেয়ে সুধার একমাত্র সন্তান, বড় আদরের নাতনী। কোন্ ছোটবেলা থেকে এসব দেখে আসছে, অন্য মাসিদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ওই তো পাণ্ডা। এখানে আসার আগে থেকেই ফোনে ফোনে সব প্ল্যান করা হয়ে যায় ওদের।

এবছরও তাই হতে পারতো, কিন্তু বাধ সেধেছে কমলিনীর ওই ঘটনাটা! সবাই তো ধরেই নিয়েছিল এবছর বড়দি আর আসতে পারবে না, কমলিনী তো নয়ই। কারণ, এতো বড় একটা ঘটনার পর কেউই ভাবেনি ওরা আসবে। গত বছর এখান থেকে ফিরে যাবার পরপরই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল কমলিনীর। কত ধুমধাম করে বিয়ে হল মেয়েটার— সবাই কত মজা করল। কত আনন্দ করে বর-বউ মিলে হানিমুন করতে গেল সিঙ্গাপুরে। কিন্তু এমনই কপাল, সেই বিয়ে আর বছর ঘুরতে পারল না। বিয়ের সাত মাসের মাথায় বাইক অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল কমলিনীর বর সুশোভন। অফিস যাবার সময়ে পেছন থেকে এসে একটা ট্রলার সজোরে ধাক্কা মারে— স্পট ডেড। হাসপাতালে নিয়ে যাবার আগেই সব শেষ হয়ে গেল!     

এসব ঘটনা কেউই সহজভাবে নেয়না, কমলিনীর অতি আধুনিক শ্বশুরবাড়িও নেয়নি। কেউই সোজাসুজি কিছু বলেনি যদিও, তবু বাতাসে অনেক কথাই উড়ে বেড়াচ্ছিল ওর শ্বশুরবাড়িতে— অপয়া, অলুক্ষণে আরো কত কি! যেন সুশোভনের এই অ্যাকসিডেন্টের জন্য কমলিনীই দায়ী।  কেমন যেন ট্রমায় চলে গিয়েছিল মেয়েটা, ঘটনাটার আকস্মিকতায়। কথা বলতো না, খেতো না, পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকত কেবল। ওর বাবা-মা বুকে পাথর রেখে মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন নিজেদের কাছে। কত কাউন্সিলিং, কত কি করে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়েছে কমলিনী। ধীরে ধীরে শোক সামলে উঠেছে মেয়েটা। আবার হাসতে শুরু করেছে, কথা বলতে শুরু করেছে। আসলে ক্ষত যত গভীরই হোক না কেন, সময় সব কিছুর উপরেই প্রলেপ লাগায়!

।।২।।

সুধাদেবীর নিজেরও একেবারেই আসার ইচ্ছা ছিল না, বিশেষ করে এই অবস্থায় মেয়েকে একা ফেলে আসেনই বা কি করে। একেবারে শেষমুহুর্তে ঠিক করেছেন যে ওকে নিয়েই আসবেন, যদি কমলিনীর মনটা ভালো হয় ভাইবোনদের কাছে পেয়ে। সতীদেবীও দেখতে চেয়েছিলেন আদরের নাতনীকে। বারবার ফোন করে আসতে বলেছিলেন, তাই আসা। সামনের ঘরে সবাই এক জায়গায় জটলা করে কমলিনীর কথাই আলোচনা করছিল। হঠাৎই বাড়ির দরজায় একটা গাড়ি এসে থামতেই, সবাই একসাথে ফিরে তাকায়। গাড়ি থেকে প্রথমে নামলেন সুধাদেবী, তারপর কমলিনী! প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে সকলে হইহই করে উঠেছিল, বিশেষ করে বাচ্চারা। দি’ভাই আসবে না শুনে ওদেরও ভীষণ মনখারাপ হয়েছিল— ওরা তাই আনন্দে চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে। কমলিনীর পরনে একটা হালকা সবুজ রঙের সালোয়ার–কামিজ। ভারী মিষ্টি দেখাচ্ছে, ঠিক যেন বিয়ের আগের সেই কমলিনী!       

মেজমাসির মেয়ে পলি তো ছুটে গিয়ে বলেই ফেলল, “দি’ভাই, তুই ছিলি না এতক্ষণ আমাদের কিচ্ছু ভালো লাগছিল না, খুব ভালো হয়েছে তুই এলি!” ছোটমাসির ছেলে, বিচ্ছুটা তো কমলিনীর কোমর জড়িয়ে নাচানাচি জুড়ে দিল— “কি মজা, কি মজা। দি’ভাই এসেছে, জানিস তো দি’ভাই সবাই বলছিল, তুই নাকি আসবিই না।” আত্মীয়স্বজনরা ততক্ষণে খবর পেয়ে  ভিড় করে এসেছে, বাড়ির কাজের লোকেরাও। যে যেখানে ছিল ছুটে এসেছিল, যেন কমলিনী একটা দেখার জিনিস! হইচই শুনে পূজার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন সতীদেবীও। তিনিই এসে মা-মেয়েকে উদ্ধার করলেন, “যাও যাও সবাই, ওদের ভেতরে আসতে দাও। এতটা পথ এসেছে, হাত-মুখ ধুক আগে। আয় মা, আয়।” ভিড় কাটিয়ে তিনিই ওদের ভেতরে নিয়ে গেলেন।    

ঘণ্টা খানেক পরেই দেখা গেল কমলিনীকে স্বমূর্তিতে, ভাইবোনেদের মাঝে বসে গল্প করতে, হাসতে, ঠিক সেই আগের মতোই। কে বলবে ক’মাস আগেই ওর বর মারা গেছে— সব্বাই হতবাক! মেয়েটার মধ্যে একটুও শোকের প্রকাশ নেই! এমন জোরে জোরে কেউ কথা বলে, হাসে নাকি! বাড়িভর্তি আত্মীয়স্বজন, কে কি ভাববে? কমলিনীর মেজ, ছোটমাসি কাজ করতে করতে নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় ফিসফিস করে সেকথাই আলোচনা করছিল। কি মেয়ে রে বাবা! কোথায় তারা ভাবলেন, সান্ত্বনা দেবেন, বোঝাবেন। কিন্তু এই মেয়ে তো হেসে গড়িয়ে পড়ছে! শোকের চিহ্নমাত্র নেই! বড়দির এবছর না আসাই উচিৎ ছিল। যদি বা এলেন মেয়েকে তো একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আনতে হয় নাকি! জামাইবাবুই বা কেমন মানুষ, ওদের আসতে দিলেন!   

কাজের লোকেরাও নিজেদের মধ্যে সেকথাই আলোচনা করছিল, আত্মীয়স্বজনরাও। কেউ কেউ তো মুখ বাঁকিয়ে বলেই ফেলল, “এতোটা বাড়াবাড়ি ভালো নয় মোটেই, দেখো মেয়েকে, বলিহারি যাই!” ব্যাপারটা কমলিনীর মায়েরও চোখ এড়ায়নি। না, বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলছে মেয়েটা, কি করে যে থামানো যায়! আসলে ভেবেছিলেন লোকজনের মধ্যে ওর মনটা ভালো থাকবে, তাই নিয়ে আসা। কেমন একটা চাপা অস্বস্তি হতে থাকে তার। একসময় আর বসে থাকতে পারলেন না, উঠে গিয়ে একথা সেকথায় মেয়েকে ঘরের বাইরে ডেকে আনলেন সুধাদেবী।

আড্ডা থেকে তুলে আনায় বিরক্ত হয় কমলিনী, বলে, “কি হয়েছে মা, কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো।” চাপা গলায় ভর্ৎসনার সুরে মেয়েকে বলেন সুধাদেবী, “সবাই কি বলাবলি করছে, বুঝতে পারছিস না? এত জোরে জোরে কেউ কথা বলে, হাসে?”

“কেন মা, কি হয়েছে?” কমলিনীর এই নিরীহ প্রশ্নের সামনে কেমন যেন থতমত খেয়ে যান, কি উত্তর দেবেন তিনি এই কথার! কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে যান, দেখতে পেলেন ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকছেন মা সতীদেবী। মায়ের হাতে পূজার সামগ্রী, তাদের মা-মেয়েকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কি বুঝলেন কে জানে। তাঁর কানেও কি কথা যায়নি? সকাল থেকে কত কথাই তো কানে আসছে তাঁরও। কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোধহয় বুঝে ফেললেন তিনি।  

জিনিসপত্র কমলিনীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে হেসে বললেন, “যা তো মা, এগুলো আমার ঘরে রেখে আয়। আমি আসছি; যা তুই।” কমলিনী ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ফিরে তাকালেন নিজের মেয়ের দিকে, সেই দৃষ্টিতে মিশে আছে একই সাথে ধিক্কার আর ভর্ৎসনা। বললেন, “বড় খুকি, তুমি বরং দেখো দেখি, সবার খাওয়া-দাওয়া হল কিনা। আমি দেখছি তোমার মেয়েকে।”

।।৩।।

সতীদেবী আস্তে আস্তে সিঁড়ির রেলিং ধরে ধরে উঠে এলেন দোতলায়। দোতলার দক্ষিণমুখী বড় ঘরখানাই তাঁর। বিয়ে হওয়া ইস্তক এই ঘরেই থাকেন তিনি। সকালের রোদ জাফরির ভিতর দিয়ে এসে পড়ে বারান্দায় ভারী সুন্দর এক নক্সা তৈরি করেছে। একটু দাঁড়িয়ে দম নিয়ে নিলেন, সিঁড়ি ভাঙার দরুন হাঁপাচ্ছেন তিনি। নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়েও থমকে গেলেন। দেখতে পেলেন, কমলিনী ওর দাদুর ফুলমালা দিয়ে সাজানো বিশাল বড় ছবিটার সামনে খাটের বাজু ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কমলিনীর ওই দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিমাটা বুকের মধ্যে ছুরির মত বেঁধে। স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ সেদিকেই তাকিয়ে থাকেন তিনি, বুকের মধ্যেটা কেমন যেন হু হু করে ওঠে। এই তো সেদিন কত আনন্দ করলেন মেয়েটার বিয়েতে, কত হইচই, মজা করলেন নাত-জামাইয়ের সাথে। গত বছর এই সময়ে কত রঙ্গই করেছেন আদরের নাতনীর সাথে! কোথা দিয়ে যে কি হয়ে গেল!          

সতীদেবী দরজাটা ভেজিয়ে এগিয়ে গেলেন কমলিনীর কাছে। কিছু না বলে টেনে এনে বসালেন ওকে নিজের সামনে, বিছানায়। ওর মলিন মুখখানি তুলে ধরে সস্নেহে বললেন, “তাকা দেখি আমার দিকে, কি হয়েছে ভাই? মা কিছু বলছিল? আমি জানি রে মা, তুই সবার সামনে কাঁদবি না বলেই অত জোরে জোরে কথা বলছিলি, হাসছিলি তাই নারে? আমার কমলিনী এত দুর্বল মেয়েই নয়।” দিম্মার সামান্য ক’টি কথাতেই কমলিনীর মনের সব বন্ধ দরজা-জানলার আগলগুলো প্রবল এক জলপ্রপাতের ধাক্কায় যেন ভেঙে পড়তে থাকে। এতক্ষণ চেপে রাখা কান্নাটা আর বাঁধ মানে না ওর। দিম্মার কোলে উপুড় হয়ে কাঁদতে থাকে হাউ হাউ করে। কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠতে থাকে ওর শরীরটা, সতীদেবীও কাঁদতে থাকেন নিঃশব্দে। না, কোন সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা তিনি করবেন না আজ। তিনি জানেন জীবনের সব কান্নার সান্ত্বনা হয় না। কেবল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শব্দহীন ভাষায় বলতে থাকেন, “ওরা শুধু তোর হাসির শব্দই শুনেছে, বুকের মধ্যে চেপে রাখা কান্নাটা দেখতে পায়নি। তুই দেখাতে চাসনি, তাই না রে? এখন কাঁদ, প্রাণভরে কেঁদে নে তুই!”

Tagged with: