‘রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বিয়ের ঠিক হয়েছিল’

সৌম্যকান্তি দত্ত

Posted On: June 26, 2021

হ্যাঁ, ঠিকই। একথা ক’জন জানেন— রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বিয়ের ঠিক হয়েছিল। তখন অবিশ্যি মৃণালিনী দেবী স্বর্গে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ভারী মনের স্বাদ ছেলের আবার বিয়ে দেবেন। এর আগে সেই পরিবারের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির যোগ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু, সে তো কবেকার কথা। তরুণ রবীন্দ্রনাথ তখন জাহাজে চেপে চলেছেন বিলেতের পথে— লেখাপড়ার তাগিদে। সেই জাহাজ-যাত্রাতেই পরিচয় হল তাঁর সমবয়সী এক তরুণ আশুতোষ চৌধুরীর সঙ্গে। বেজায় মিশুখে সে তরুণ। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’-তে লিখেছেন— “কলিকাতা হইতে মাদ্রাজ পর্যন্ত কেবল কয়টা দিন আমরা জাহাজে একত্র ছিলাম। কিন্তু দেখা গেল, পরিচয়ের গভীরতা দিনসংখ্যার উপর নির্ভর করে না। একটি অতি সহজ সহৃদয়তার দ্বারা অল্পক্ষণের মধ্যেইন তিনি এমন করিয়া আমার চিত্ত অধিকার করিয়া লইলেন যে পূর্বে তাঁহার সঙ্গে যে দেখাশোনা ছিল না সেই ফাঁকটা এই কয়দিনের মধ্যেই যেন আগাগোড়া ভরিয়া গেল।” বিলেত ফেরত সেই তরুণই পরবর্তীকালে কলকাতা হাইকোর্টের নাজাদা ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরী। তাঁরই বোনের মেয়ে প্রিয়ম্বদা দেবী— পরবর্তীকালে আপন সৃষ্টির জোড়ে পাঠকমহলে যিনি কবি প্রিয়ম্বদা দেবী হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছিলেন। এই প্রিয়ম্বদা দেবীকে মুখ্য চরিত্র করেই প্রাবন্ধিক পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বই ‘রবীন্দ্রনাথ ও প্রিয়ম্বদা একটি অনালোকিত সম্পর্ক’— যা নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রচর্চার এক নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

       পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বইয়ের একটি অংশে লিখেছেন—“দুর্গাদাস চৌধুরীর বাড়িতে প্রিয়ম্বদার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যখন প্রথম দেখা হয়, তখন তিনি পনেরো বছরের প্রাণময়ী। প্রাণময়ী প্রিয়ম্বদা প্রিয়ভাষিণী হয়ে উঠেছিলেন কিনা সে-বিবরণ অবশ্য কোথাও নেই। রবীন্দ্রনাথ তিন-চারদিন টানা ছিলেন কৃষ্ণনগরে। চার বন্ধুতে আনন্দে আহ্লাদে কেটেছিল। সেই মজলিশে কবি গানও গেয়েছিলেন। প্রমথ চৌধুরী জানিয়েছিলেন, ‘তিনি একটি হিন্দী গান গেয়েছিলেন। তার প্রথম কথাগুলি ‘জন ছুঁয়া মোরি বঁইয়া নাগরওয়া।” রবীন্দ্রনাথের সেজদা হেমেন্দ্রনাথের অকাল মৃত্যুর কাহিনি আমরা অনেকেই জানি। তাঁর মৃত্যু-পরবর্তীতে তাঁর কন্যা প্রতিভাসুন্দরীর বিয়ে দেওয়ার সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন কাকা রবীন্দ্রনাথ। বিয়ে দিলেন এই আশুতোশ চৌধুরীর সঙ্গেই। অপরদিকে তাঁর ভাই প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয় রবীন্দ্রনাথের খুব স্নেহের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীর। আলোচ্য গ্রন্থের রচয়িতা পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় আন্তরিক পরিশ্রমের দ্বারা ইতিহাস ঘেঁটে বের করেছেন প্রিয়ম্বদা দেবী সম্বন্ধে অজস্র অজানা তথ্য। প্রিয়ম্বদার বিয়ে হয় একুশ বছর বয়েসে— যা সেই আমলে বেশ সমালোচিত একটা ব্যাপার, এ নিশ্চয়ই সহজেই অনুমেয়। যে বছর তাঁর বিয়ে হয়, ঠুইক সে বছরই তিনি বেথুন কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। প্রিয়ম্বদার বিয়ে হয় সে আমলের নামকরা প্রবাসী আইনজীবী তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বিয়ের দু’বছরের মাথায় একটি শিশুসন্তানও আসে তারাদার-প্রিয়ম্বদার ছোট্ট সংসারে। কিন্তু হায়! সন্তানটি যখন সবে এক বছরে পড়েছে, ঠিক সে সময়েই তাঁর বাবা, প্রিয়ম্বদার স্বামী তারাদাসবাবুর অকাল প্রয়াণ ঘটল ক্ষয়রোগে ভুগে। সন্তানকে বুকে আগলে এরপর কিছুকাল কাটল বটে। কিন্তু সেটুকু সুখও বুঝি তাঁর কপালে সইল না। একমাত্র সন্তান যখন দশের কোটা পেরিয়ে এগারো বছরে পা রাখল— তখন তার জীবনটা এক নিমেষে শেষ হয়ে গেল। স্বামীহারা, সন্তানহারা প্রিয়ম্বদা শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়তেই পারতেন। কিন্তু তা হল না— সৃষ্টিশীলতা, জীবনের বোধ, রবীন্দ্রনাথের মতো ঋষিতুল্য মানবের সংস্পর্শে এসে তিনি সব হারিয়েও এক নতুন জীবন আবার খুঁজে বের করতে পেরেছিলেন। আর এখানেই তো প্রিয়ম্বদা দেবীর সার্থকতা। প্রাবন্ধিক পার্থজিতের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, রবীন্দ্রনাথ তখন তিরিশ পেরিয়ে একত্রিশ বছরে বয়েসে পা রাখলেন। সেই জন্মদিন উপলক্ষ্যে ছোট্ট একটা বাঁধানো নোটবুক রবীন্দ্রনাথকে উপহার দিয়েছিলেন প্রিয়ম্বদা দেবী। তাতে লিখে দিয়েছিলেন— ‘রবিবাবুকে জন্মদিনের উপহার। প্রিয়। ২৫ শে বৈশাখ ১২৯৮।’ বর্তমানে শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত এই খাতাতেই রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখায় ‘চিত্রা’ ও ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের বেশ কিছু কবিতা পাওয়া গিয়েছে। ঠাকুরবাড়ির ঘরের পত্রিকা ‘ভারতী’-তে একসময় বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন কবি প্রিয়ম্বদা দেবী— যার অনেক কবিতাই লেখা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কালের নিয়মে আজ সে সব কবিতাকে বাঙালি পাঠক প্রায় ভুলতেই বসেছেন। দে’জ পাবলিশিং-এর কল্যাণে ও পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নিরলস পরিশ্রমের ফল এই গ্রন্থ ‘রবীন্দ্রনাথ ও প্রিয়ম্বদা একটি অনালোকিত সম্পর্ক’ আমাদের স্মৃতিকে উসকে দেয়— আমাদের চেতনাকে সমৃদ্ধ করে, আমাদের রবীন্দ্রচর্চার পরিধিকে সমৃদ্ধ করে নিঃসন্দেহে। কেন না, প্রিয়ম্বদা দেবীর কবিতার মতো আমরা মানুষ প্রিয়ম্বদা এবং রবীন্দ্রসংস্পর্শে থাকা এক বিদুষী নারীকেই প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম।

রবীন্দ্রনাথ ও প্রিয়ম্বদা একটি অনালোকিত সম্পর্ক
পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
দে’জ পাবলিশিং
১২০.০০

Tagged with: