বিষাদচন্দ্রিমা

দিলীপ কুমার ঘোষ

Posted On: July 4, 2021

টিলা থেকে নেমে আসার আগে পর্যন্ত বেশ ভালই লাগছিল চন্দ্রিমার। লাল মাটির জেলা বাঁকুড়া। অনুচ্চ পাহাড় শুশুনিয়া কেমন যেন সেখানে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। তার উপর যারা চড়ে, তাদেরও খুব অসুবিধা হয় না। পাহাড়ের খাড়াই উচ্চতা দুর্বল হৃদয়ের মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করে, এখানে কিন্তু তেমনটা নয়।

এমনিতে পাহাড় তাকে টানে না, পাহাড় সায়নকে টানে। সেই টানেই চন্দ্রিমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দু’দিনের জন্য এখানে নিয়ে হাজির হয়েছে সায়ন। চন্দ্রিমার ভাল লাগে সমুদ্র। সমুদ্র কেমন সব ফিরিয়ে দেয়। স্মৃতি হোক, স্মারক হোক— সব কেমন ফিরে আসার আশ্বাস থাকে সমুদ্রে। বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাবে সে তাই খুব ধরেছিল দীঘা বা পুরী যাবে বলে। কিন্তু সমুদ্র ঘিরে অদ্ভুত বিতৃষ্ণা রয়েছে সায়নের। কিছুতেই সে তাই তার প্রস্তাবে সম্মতিজ্ঞাপন করতে পারেনি। এদিকে চন্দ্রিমাও প্রথমে পাহাড়ে আসতে কিছুতে রাজি হচ্ছিল না। সায়ন শেষমেশ হতাশার সঙ্গে বলে, “আমি জানতাম তোমার পাহাড়ে চড়তে ভয়, কিন্তু এখন দেখছি তুমি টিলাকেও পাহাড় ভেবে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছ!” নিজেকে ভীরু ভাবতে একদম পছন্দ করে না চন্দ্রিমা। অগত্যা সায়নের প্রস্তাবে নিমরাজি হয় সে।

আর সত্যি বলতে কী, বিয়ের পাঁচ বছর পর এই তো প্রথম ঘুরতে আসা! লোকে হানিমুনে কোথাও না কোথাও যায়। তাদের কপালে সেটুকুও জোটেনি। তাদের যাওয়া বলতে বেশ ক’বার সায়নের দেশের বাড়িতে যাওয়া। তা সেখানে গিয়েও রাত কাটানো আর হয়ে ওঠেনি। বিয়ের পর থেকে ফ্ল্যাটের বাইরে একসঙ্গে একটা রাতও কাটায়নি তারা। তাই কিছুটা বিদ্রুপের সুরেই চন্দ্রিমা বলেছিল, “পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে এই আমাদের প্রথম আউটডোর মধুচন্দ্রিমা!”

“আউটডোর মধুচন্দ্রিমা?”

“আউটডোর মানে আউটডোর। ফ্ল্যাটের বাইরে এই প্রথমবার মধুচন্দ্রিমার চান্দ্ররাত যাপন। তবে…”

সকালে এখানে এসে হোটেলে উঠেছে তারা। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বিশ্রাম নিয়ে বিকালে যখন তারা বেরোচ্ছিল, হোটেল ম্যানেজার বলল, “একটু সতর্ক থাকবেন কিন্তু। কয়েক দিন আগে এখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। একটা চার-পাঁচ বছরের ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ছেলেটাকে নিয়ে বাবা-মা পাহাড়ে চড়েছিল। আর সেদিন সন্ধ্যা থেকেই ছেলেটা মিসিং। অনুসন্ধান চলছে, কিন্তু ছেলেটার এখনও কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।”

কথাটা শোনার পর তার জীবনে ঘটে যাওয়া এমনই একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল চন্দ্রিমার। কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে রইল সে। কতই বা বয়স তখন তার! বড়জোর পাঁচ। সে হারিয়ে গিয়েছিল! হ্যাঁ, সে সত্যিই হারিয়ে গিয়েছিল। পুরো ঘটনাটা স্পষ্ট মনে না-পড়লেও, তার আবছা-আবছা মনে পড়ে সেদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে বাবার হাত ধরে সমুদ্রের ধার দিয়ে সে হাঁটছিল। তারপর কখন যেন সে বাবার হাত ছাড়িয়ে নেয়। বাবা এমনিতে উদাসীন প্রকৃতির মানুষ। একটু অন্যমনস্কও বটে। জলের দিকে চেয়ে হাঁটছিল। চন্দ্রিমা এক মনে পাড়ে ঢেউয়ের আছড়ে পড়া দেখতে দেখতে কখন যেন থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ পাশ ফিরে দেখে বাবা নেই। বাবাকে দেখতে না পেয়ে সে কেমন ঘাবড়ে গিয়েছিল। তার খুব ভয় করছিল। আর কী হয়েছিল তার ঠিক মনে পড়ে না। সে মনে হয় দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেঁদে, ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছিল। তার শুধু মনে পড়ে যে বাবা সহজে কোলে নিতে চাইত না, সেই বাবাই তাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে আঁকড়ে জড়িয়ে ধরছে এবং কোলে তুলে নিচ্ছে। বাবাকে কেমন দিশেহারা, বিভ্রান্ত লাগছিল। বাবা যে অনেক খোঁজ করার পর তাকে খুঁজে পেয়েছে, তা এতটুকু বুঝতে দেয়নি। চন্দ্রিমার শুধু মনে আছে পরদিনই বাড়ি ফেরার ট্রেনে উঠেছিল তারা।

সেদিন যে-প্রশ্ন মনে জাগেনি, আজ সেই প্রশ্ন মনে জাগে তার— আচ্ছা, সেদিনই কি তাদের ফেরার কথা ছিল না বাবা হঠাৎ করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? চন্দ্রিমার মনে হল প্রশ্নটার উত্তর যেন আজ সে বুঝতে পারছে‌। আর একটা ধোঁয়াশাও যেন তার চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে।

পাহাড়ে কিছুটা ওঠার পরই তার কারণে থেমে যেতে হল সায়নকে। সূর্যাস্তের বেশি দেরি ছিল না। পশ্চিমাকাশে তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে থাকা চন্দ্রিমার কাছে ফিরে এসে তার হাত ধরে সায়ন বলে উঠল, “পাহাড়ি রুক্ষতার মধ্যে তুমি যেন বড়ই পেলব।” সামান্য চমকে উঠল চন্দ্রিমা। তারপর ঈষৎ লজ্জিত মুখে সায়নের দিকে ফিরে তাকাল সে। একসঙ্গে যখন তারা আবার পাহাড়ে চড়তে লাগল চন্দ্রিমা ভাবল সায়নকে বলে, “আমার কিন্তু পাহাড় আজ ভাল লাগছে।” কিন্তু সায়নের দিকে তাকিয়ে নিজেকে বিরত করল। সায়নকে দেখে তার মনে হল ধ্যানগম্ভীর, জাগতিক বোধশূন্য। চন্দ্রিমার মন সায় দিল না নির্লিপ্ততায় আচ্ছন্ন সায়নকে আলোড়িত করতে।

টিলার শেষ সীমায় উঠে এল তারা। সূর্য তখন অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতিতে মগ্ন। সমস্ত পশ্চিমাকাশে আবীর রং ছড়িয়ে আবছায়ামাখা বিকেল আস্তে আস্তে গড়িয়ে যাচ্ছিল গোধূলিতে। একঝাঁক পাখি উড়ে গেল উত্তর থেকে দক্ষিণে। একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল চন্দ্রিমা। চোখে তার অচঞ্চল স্তিমিত ভাব। অদ্ভুত এক প্রশান্তি এসে ঘিরে ধরল তাকে। কতক্ষণ কাটল তার খেয়াল ছিল না। আচমকা শিহরিত হল সে। দেখল একটা চার-পাঁচ বছরের শিশু এগিয়ে আসছে। সায়নও সেদিকে তাকাল। স্থানীয় ছেলেটাকে দেখে তার কোনও ভাবান্তর হল না। কিছু পরে ছেলেটা নামতে শুরু করল। বিহ্বল চন্দ্রিমাও নিঃশব্দে ছেলেটাকে অনুসরণ করে নামার পথ ধরল। এত তাড়াতাড়ি টিলা থেকে নামার ইচ্ছা না থাকলেও সায়ন একপ্রকার বাধ্য হয়ে চন্দ্রিমাকে সঙ্গ দিয়ে নেমে আসতে লাগল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে দুজনেই ছেলেটাকে আর দেখতে পেল না।

চন্দ্রিমা বলল, “কী আশ্চর্য! অতটুকু ছেলে মুহূর্তের মধ্যে কোথায় চলে গেল?”

“দেখে তো মনে হল এখানকার স্থানীয় ছেলে। টিলা থেকে সহজে নামার অন্য কোনও রাস্তা হয়তো ওর জানা আছে, আমাদের চোখের আড়ালে সেটা দিয়েই হয়তো নেমে গেছে।”

“ছেলেটাকে একা টিলার মাথায় ঘুরতে দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম। আমার কেমন মনে হচ্ছিল— আমার চোখের সামনে কোনও অপার্থিব ঘটনা ঘটে চলেছে।”

রাতে ঘুমোতে পারছিল না চন্দ্রিমা। ছটফট করছিল। সে কি সত্যিই আর ঘুমোতে পারবে না নাকি? রাত ক’টা বাজল, কে জানে! সময় সম্বন্ধে সমস্ত বোধ তার লোপ পেয়ে যাচ্ছে। সায়ন কেমন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন! হিংসে করতে ইচ্ছা হয়। নিঃসঙ্গতা আবার তাকে সেই মনখারাপ করা ভাবনায় জড়াচ্ছে। ঘুমের জন্য প্রয়োজন ভারহীন মন। কিন্তু বুকে ক্রমশ ভার যেন চেপে বসছে। অথচ ঘুম না হলেই নয়। কি মরতে যে ছেলেটাকে অনুসরণ করতে গেল! কাল এখান থেকে বিদায় নিতে পারলে বাঁচে। তার মনে হয় না এলেই বোধ হয় ভাল হত। সংসারের পাঁচটা কাজে তবু ভুলে থাকা যায়। কিন্তু প্রকৃতির কোলে এসে নিজের ফাঁকা কোল যেন বড় বাজে!

ছেলেটাকে দেখে তার মধ্যে যে কী হচ্ছিল, সে কাউকে সেটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলতে পারবে না। কাউকে বলতে সে চায়ও না। যখন সম্ভাবনা ছিল, তখন বিষয়টা শুধু সময়ের অপেক্ষা জেনে আলাদা করে তার কিছুই মনে হয়নি। আর যেদিন সকলের ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে, নিজের প্রাণ বাঁচানোর স্বার্থে, সে নার্সিংহোম ত্যাগ করে আসতে বাধ্য হল তার কাঙারুর থলি সেদিন থেকে তার স্বপ্নে শুধু ঘোরাফেরা করতে লাগল।

কয়েক দিন আগে যে শিশুটা হারিয়েছে তাকে ফিরে পাওয়ার তবু একটা সম্ভাবনা আছে। বছর পাঁচেকের চন্দ্রিমাকেও তার বাবা অবশেষে খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু যাকে তারা দু’জনেই দেখেছিল সে শেষ পর্যন্ত হারিয়ে গেল কেন! আসলে তাকে যে তারা আর কোনও দিনই খুঁজে পাবে না।

Tagged with: