মায়াকাহিনী

সৌরদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted On: July 2, 2021

এই কাহিনীর সূত্রপাত ২০১০ সালে তাড়োবার মোহর্লি জঙ্গলে। সেখানকার বাঘিনী লীলা চারটে শাবকের জন্ম দেয় – পাণ্ডু, লতা, ছায়া আর মায়া। আজ এই মায়ার গল্পই বলব, যিনি বর্তমানে T12 নামে পরিচিত। আপনারা হয়তো ভাবছেন দেশজুড়ে অসুস্থতা, রাজনৈতিক জটিলতা, শিক্ষাগত অরাজকতার মতো কঠিন কঠিন বিষয় ছেড়ে হঠাৎ এক বাঘিনীকে নিয়ে পড়লাম কেন! কারণ আর কিছুই নয়, বেঁচে থাকার লড়াই, দুঃখ, হতাশা ইত্যাদি মানসিক আর দৈনন্দিন দ্বন্দ্বগুলি কেবল সমাজজীবন নয়, জঙ্গলজীবনের প্রাণীদেরও ভোগ করতে হয়। তারই এক জলজ্যান্ত উদাহরণ হল তাড়োবার বিখ্যাত বাঘিনী মায়া।

মায়ার ছোটবেলা কেটেছে খুব সম্ভবত পান্ধফোনি এলাকায়। বছর দশেক আগের তাড়োবার পর্যটকদের ভ্রমণকাহিনী পড়লে জানা যায় মূলত পান্ধফোনিতেই লীলাকে দেখা যেত চার ছানাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, মায়া ছিল লীলার দ্বিতীয় সন্তান, তখন তাকে P2 নামে সনাক্ত করা হত। এই দ্বিতীয় কন্যাই পরবর্তীকালে লীলার সিংহাসন দখল করে। লীলার মৃত্যু হয় ২০১২ সালের নভেম্বরে, তার কিছুদিনের মধ্যেই অন্যান্য ভাইবোনকে হারিয়ে মায়া তাড়োবার রাজত্ব দখল করে, অর্থাৎ টেরিটরির নিয়ন্ত্রণ নেয়। তারপর মহিয়সীচালে চলতে থাকে মায়ার রাজপাট। ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে তাড়োবার মুখ্য আকর্ষণ।

ক্ষমতা, পরিচিতি আর প্রতিষ্ঠা লাভের পর মনের পরবর্তী খোরাক হল প্রেম। আর এই খোরাক মেটাতেই মায়ার জীবনে আসে গাব্বার নামক এক বাঘ। এই বাঘ আর বাঘিনীর সঙ্গমে ২০১৪ সালে তাড়োবার পঞ্চধারা এলাকায় জন্মগ্রহণ করে মায়ার দুই সন্তান। প্রথম মাতৃত্বের অনুভবে মায়ার জীবনে আনন্দের বাঁধ ভাঙে। কিন্তু বাঁধ ভাঙলে কী আনন্দ আর থাকে! বন্যার মতোই দুর্বিসহ দুঃখ নেমে আসে মায়ার জীবনে। এক মাসের মধ্যেই মারা যায় তার দুই সন্তান। ভেঙে যায় মায়ার মন। তবে কথায় আছে, বাঘিনীর মন যতটা আবেগপ্রবণ ঠিক ততটাই বাস্তববাদী। তাই শোক কাটিয়ে মায়া আবার সংসারে মন দেয়। শুধু সংসারেই নয়, মন দিয়ে ফেলে স্যাটার্ন নামক আরেক পুরুষ বাঘকে। অবশেষে স্যাটার্ন আর গাব্বারের সঙ্গে সহবাসে ২০১৫ সালে সে জন্ম দেয় তিনটে শাবকের, একটি ছেলে আর দুটি মেয়ে।

আবার শুরু হল মায়ার সুখের সংসার। তবে এবারও সুখ বেশিদিন টিকল না। পুরনো বাংলা সিনেমায় নায়িকাদের উদ্দেশ্যে একটা সংলাপ শোনা যেত, ‘সৌন্দর্য্যই ওর সবথেকে বড় শত্রু’। হয়ত মায়ার ক্ষেত্রেও এই কথাটা খাটে। সুন্দরী আর ব্যক্তিত্বময়ী মায়ার প্রতি বেশ কিছুদিন ধরেই আকৃষ্ট ছিল তাড়োবার বিখ্যাত বাঘ, মৎকাসুর। তাই প্রতিহিংসাবশত অথবা অন্য কোনও কারণে সে মায়ার বাচ্চাদের ওপর আক্রমণ করে। ভাগ্যবশত পুত্রসন্তান ভোলা প্রাণে বেঁচে যায়, কিন্তু দুই কন্যার মৃত্যু ঘটে। তাই কাল বিলম্ব না করে ভোলা আর গাব্বার সহ মায়া তার টেরিটরি ত্যাগ করে অন্যত্র পলায়ন করে।

তবে জঙ্গলের আইন অত্যন্ত কঠোর। আমাদের মতো আইনের কোনও ফাঁকফোকর নেই সেখানে। কাজেই কোনও বাঘ এভাবে অন্যের টেরিটরিতে অবাধে ঢুকে যেতে পারে না। নিয়ম হল, হয় লড়াই করে সেই টেরিটরি দখল করতে হবে অথবা প্রাণ খোয়াতে হবে। আর দুর্ভাগ্যবশত এই টেরিটরির প্রতিপক্ষ ছিল স্বয়ং মৎকাসুর। ‘Survival of the fittest’ নীতিতে বিশ্বাস করে অথবা প্রতিশোধ স্পৃহায় গাব্বার এগিয়ে যায় মৎকাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। তবে মৎকাসুরের দানবিক ক্ষমতার কাছে পরাজিত হয় গাব্বার আর আত্মসম্মান খুইয়ে টেরিটরি ছেড়ে পালিয়ে যায় জঙ্গলের বাফার এলাকায়। কাজেই টেরিটরি আর মায়ার দখল নেয় মৎকাসুর। পরাজিত হয়েই হোক কিংবা মৎকাসুরের মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ পৌরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, মায়া তার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয় আর ২০১৭ সালে দুই বাচ্চার জন্ম দেয়, মীরা আর সূর্য। তবে মায়ার সন্তানভাগ্যই হয়ত খারাপ। ২০১৯ সালে এক গাউরকে শিকার করতে গিয়ে মীরা প্রাণ হারায় আর সূর্যকে স্থানীয় করহণ্ডলা অভয়ারণ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। 

তবে নিজের খারাপ সন্তানভাগ্যকে চ্যালেঞ্জ করে ২০২০ সালের মার্চ মাসে পাঁচটি সন্তানের জন্ম দেয় মায়া। তবে এই পাঁচশাবকের পিতা মৎকাসুর কিনা তা নিয়ে অবিশ্যি জঙ্গলে কানাঘুষো আছে। নিন্দুকেরা বলে, কোলসার পুরুষ বাঘ টালার সঙ্গে নাকি মায়া খানিক মেলামেশা করেছিল। সে যাইহোক, পিতৃপরিচয় নিয়ে কেচ্ছা তো সর্বত্রই বিরাজমান, তাতে কী এসে যায়! নিজের ইচ্ছানুসারে মাতৃত্বের দায়িত্ব নেওয়াটাই বড় ব্যাপার। ঠিক যেমন মায়া নিয়েছে। বছরখানেক ধরে তার কোনও খবর পাওয়া যায়নি ঠিকই, তবে আমার বিশ্বাস মহাভারতের কুন্তি আর পাণ্ডবের মতো মায়া তার পাঁচসন্তানকে নিয়ে বনপর্ব উপভোগ করছে।

ফোটো- প্রান্তিক চ্যাটার্জী

Tagged with: , , ,