মাটির শরীর

সায়ণী ঘোষ

Posted On: July 18, 2021

কাল বাড়িতে ঘটা করে লক্ষ্মীপুজো হল। আজ সকালেই সুতো কেটে দিয়েছেন ঠাকুরমশাই। দত্তবাড়ির মেয়েবউরা আবার রোজের কাজে লেগে পড়েছে। আলপনা পাহারা দিচ্ছে না আর কেউ; তাই বাচ্চারা সব মাড়িয়ে মাড়িয়ে খেলছে। দালানে শুকনো ফুলের মালা পরে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তিটা।
“ও হরিপদ, যাও না মূর্তিটা সামনের বটতলায় গিয়ে রেখে এসো।”
দত্তবাড়ির কর্তা হুকুমখানা দিয়েই দালান পেরিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। হরিপদ জানত মূর্তি বিসর্জন দেওয়া যাবে না। কিন্তু বটতলাতে আগে থেকেই অনেক বাড়ির মূর্তি সব ফেলে রেখে গেছে। তারা কোথায় যে রাখে!
আজ বিনুর কলেজ নেই। বারান্দায় কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছিল সে।হরিপদ ডাক দিল, “ও ছোটবাবু, একটু ধরবে মূর্তিখানা? একা তো… ওই বটতলায় রেখে দিতে যাচ্ছিলুম আর কি!”
“হ্যাঁ হ্যাঁ চল, আমি ধরছি। আচ্ছা একটু দাঁড়াও জামাটা পালটেই আসছি। ফেরার পথে আকাশের বাড়ি থেকেও ঘুরে আসা যাবে।”
বটতলার সামনে এই দৃশ্যখানা আসতে যেতেই দেখে বিনু, তবে এত কাছ থেকে দেখেনি কখনও। কারুর মুকুট খুলে পড়েছে, শুকনো ফুলমালা ঝুলছে, রঙ কালোটে হয়ে গেছে, কি বীভৎস দশা সব মূর্তিগুলোর! মুখে একটা অদ্ভুত কষ্ট— সেটা মাটির, তাও কেমন যেন অনুভব করছিল বিনু। কে জানে কবে থেকে পড়ে আছে এই খোলায়। আগে যাদের নিয়ে এত মাতামাতি , আজ আর কেউ ফিরেও দেখে না।
ওদের লক্ষ্মী ঠাকুরের মুখখানা ভারী সুন্দর। ও বন্ধুদের সাথে গিয়ে অর্ডার দিয়ে এসেছিল। ভাবল কিছুদিন পর এরও এমনিই দশা হবে! আর মনটা যেন ভারী হয়ে এল।
“এখানেই রাখতে হবে হরিদা? কোনো মন্দিরে রেখে এলে হয়না? বর্ষা এলে তো পুরো ধুয়ে ধুয়ে খারাপ হয়ে যাবে।”
ও পুজোর নিয়মবিধি অত বোঝে না। দেখে প্রতিবারই ভাসান হয় কিন্তু এবারে নাকি ঠাকুরমশাই বলেছেন ভাসান দেওয়া যাবে না।
“না না, মন্দিরে রাখতে দেবে না, দেখছ না এখানেই সবাই রেখে গ্যাছে!”
ওর মনটা খুঁত-খুঁত করছে খুব। বটতলার চারদিকে গোল করা লাল সিমেন্টের বাঁধানো মত জায়গাটায়, যতটা সম্ভব গাছের গায়ে ঠেসিয়ে রাখল মূর্তিটা। পিছন থেকে একটা আওয়াজ পেয়েই ফিরে তাকালো সে। পাশের বাড়ির গণেশদা।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিও একবার… ওইটার নিয়ম হচ্ছে বর্ষা এলে ধুয়ে নিজেই ভাসান হয়ে যাবে বুঝলে! হেঃ হেঃ…”
একটু থেমে আরও বলল, “তা আজ কি ছুটি নাকি কলেজ? ঋতু তো অফিস ট্যুরে গেছে তাই না! এই তো সেদিনই দেখা হয়েছিল রাস্তায়…”
ঋতু হল বিনুর দিদি। ওর বড় কাছের। তবে জ্যেঠতুতো। পরিসর দত্তের বড়মেয়ে। ওরা মফস্বল এলাকার একটি বনেদি যৌথ পরিবার। অনেক আপত্তি তুচ্ছ করে কলকাতায় চাকরি করছে ঋতু। বাড়ির সবারই বড় আদরের ও। অফিস ট্যুর থেকে আজই ফিরবে, তাই বাড়িতে ভাল ভাল রান্না চলছে।
দিনটা বন্ধুদের সাথে গল্প-গুজব করে কাটিয়ে দিল বিনু। রাত তেমন হয়নি যে ফেরার জন্যে মা তাড়া দেবে, কিন্তু তাও কেন মা ফোন করছে! একটু ভাবল। ফোনটা ধরতেই মায়ের উদ্বিগ্ন গলা শুনতে পেল সে। ওরও জানা ছিল যে আজ সকালেই ঋতুর ফেরার কথা। দুপুরে বেরোনোর সময় সবাই বলছিল একটু হয়ত লেট হচ্ছে, ট্রেনের ব্যাপার তো। কিন্তু এখনও ফেরেনি। ওকে এক্ষুনি বাড়ি আসতে বলা হল। কি যেন একটা খবর পাওয়া গেছে; মা খুলে বললেন না তখন।

কলকাতার একটা নামী হাসপাতালের করিডরে বসে আছে বিনু। ঋতু ভর্তি রয়েছে সেখানে। কি হয়েছিল কেউ বিনুকে ঠিক খুলে বলছে না। কানাঘুষো চাপা কান্নায় ও একটু একটু বুঝতে পেরেছিল। তবে বেশি বুঝেছিল যে ঋতু ভাল নেই। শুয়ে আছে, হুঁশ নেই তার— মুখে মাস্ক পরানো।
বাড়ি আসতে কয়েকটা কথা শুনে ও সবটা বুঝল। যেমন, “এবার আমরা সমাজে মুখ দেখাব কি করে? বলেছিলাম এত দূরে যাবার দরকার নেই,” এরকম আরও কতও কি। কেউ বলছিল, কেউ বলছিল না; কিন্তু সবাই ভাবছিল। সেটা বিনু স্পষ্ট বুঝতে পারছিল।
এক হপ্তা কেটে গেছে। বাড়ির পরিবেশ থমথমে। আজ ঋতু ফিরবে হাসপাতাল থেকে। কিন্তু আজ কেউ ভালো ভালো রান্না করেনি বাড়িতে। সবাই কেমন যেন মুখ লুকিয়ে বেড়াচ্ছে পাড়ায়। জ্যেঠিমা তো ঘরে নিজেকে বন্দি করে নিয়েছেন। যখন সে এল, বিনু দেখল এ কি অবস্থা ঋতুর ! বিষণ্ণ মুখ মাটিতে মিশিয়ে নিতে চাইছে সে। কেউ ওর সামনে কিছুই বলছে না। বিনুরও পা সরল না।
ঋতুর ঘরের দিকে কেউ যাচ্ছে না। রাতে বিনু গেল। দ্যাখে, অগোছালো চুল ছাড়া। চোখে-মুখে কালি পড়ে গেছে। সেই হসপিটালের ময়লা জামাটাই পরে আছে এখনও। চোখগুলো নিথর। বিনুর বুকটা কেঁপে উঠল। এ যেন সেই এক দৃশ্য— বটতলায় বসানো মূর্তিগুলোর মত। কিছুক্ষণ কথা বলল ঋতুর সঙ্গে। সাহস জোগানোর চেষ্টা করল। ও উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে। যেন দৃষ্টিহীন দুটো চোখ। শুধু একটাই কথা বলল কয়েকবার, “মা একবারও এল না; বাবাও না।”
রাতে নানা চিন্তা দানা বাঁধল বিনুর মনে। সমাজের কাছে সুতো কেটে দেওয়া মানে ঠাকুরের সব সন্মান, সব শ্রদ্ধা চলে যাওয়া— তখন সেটা শুধু একটা মাটির ডেলা! কেউ আর ফিরেও তাকায় না তার দিকে। কিন্তু, ঋতুদির সাথে সেইসব মূর্তির এত সাদৃশ্য খুঁজে পাচ্ছে কেন ও?
ওর মনে প্রশ্নের ঝড় উঠল। ঋতুদির সব শুচিতা, সব সন্মান স্রেফ একটা ঘটনায় শেষ! রাগে ওর গা রি রি করে উঠল।

রাতে ভীষণ ঝড় জল হল। তুমুল বর্ষা। সকালে জোরে জোরে দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভাঙল বিনুর। সুইসাইড করেছে ঋতুদি— বাঁচার কোনও আশা নেই। বাঁচলও না। শ্মশান থেকে ফেরার পথে বিনুর চোখ পড়ল বটতলার দিকে। তাদের মূর্তিটাও প্রায় গলে গেছে, চোখ মুখ কিচ্ছু নেই আর।

Tagged with: