ব্রাত্য জীবন

মিঠুন মুখার্জী

Posted On: August 1, 2021

সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মালেই সবার কপালে সুখ থাকে না। ছয় ষষ্ঠীতে ভাগ্যদেবতা যা লেখার লিখে দেয়, তাকে কেউ খন্ডন করতে পারে না। কলকাতা শহরের মস্ত বড় এক ব্যবসায়ী দীপঙ্কর রায়ের দুই ছেলের পরে এক মেয়ে। ছেলে পছন্দ হলেও মেয়ে সন্তান তার একদম পছন্দ নয়। বছর পাঁচেক আগে তার সহধর্মিনী আরও এক সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু সেই সন্তানটি ছিল আবার তৃতীয় লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত। বাবা সেই খবর পাওয়ার পরই পন করেন এই সন্তানের মুখ তিনি জীবনেও দেখবেন না। তাই সিদ্ধান্ত নেন অনাথ আশ্রমে সন্তানটিকে চুপিচুপি দিয়ে আসবেন। কথায় যা, কাজেও তাই। সকলের অমত থাকা সত্ত্বেও মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ধন নিয়ে যাওয়া হয়। সন্তান যেমনই হোক মায়ের কাছে সে সন্তানই হয়। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা একজন মা ছাড়া কেউ বুঝতে পারেন না।

আজ সেই তৃতীয় লিঙ্গের সন্তানটি পাঁচ বছরে পড়েছে। অনাথ ছেলেমেয়েদের মাঝখানে বাবা-মা থাকা সত্ত্বেও অনাথের মতো মানুষ হতে হয় তাকে। এই অপরাধ কার? এদিকে অনাথ আশ্রমে তার নাম হয় বৃন্দাবনী। তার দুই দাদা যথাক্রমে অরুময় ও রাধেময়, এবং দিদির নাম শ্যামা। অরুময় ও রাধেময় যমজ হওয়ায় তারা এখন একাদশ শ্রেণীতে পড়ে এবং শ্যামা নবম শ্রেণীতে। ছেলে দুটি দীপঙ্করবাবুর গর্বের হলেও শ্যামাকে তিনি তেমন স্নেহ করেন না। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও মেয়েরা এখনও যে ব্রাত্য সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ছোট সন্তানের শোকে মা অসুস্থ দীর্ঘদিন। তাই ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করার জন্য দু’জন কাজের লোক রেখেছেন দীপঙ্করবাবু। এদিকে কোনরকমে অবহেলায় বেড়ে উঠতে থাকে বৃন্দাবনী।

দশবছর অতিক্রান্ত। দীপঙ্করবাবুর এখন বয়সের দরুন তার কাজকর্ম অরুময় ও রাধেময় দেখাশোনা করতে শুরু করেছেন। এক উচ্চবংশের ব্যবসায়ীর ছেলের সাথে শ্যামার বিয়ে দিয়েছেন তিনি। মাঝেমধ্যে ছেলেদের মাধ্যমে তার খোঁজখবর নেন। বাবার এহেন আচরণ শ্যামার চোখে বুক ফেটে জল এনে দেয়। হঠাৎ অসুস্থতা কিছু গুরুতর হওয়ায় একদিন শ্যামার মা পরলোক গমন করেন। তার কাজ সম্পন্ন করে দীপঙ্করবাবু ছেলেদের বলেন, “তোমাদের মা-র চলে যাওয়ায় আমার মনের শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে, আমি কিছুদিনের জন্য হরিদ্বারে তীর্থ করতে যাব। তোমরা বড় হয়েছ, ব্যবসা সামলানোর ক্ষমতা হয়েছে, আমার আর চিন্তা নেই। কাজেই ব্যবসার ভার তোমাদের ওপর ছেড়ে দিয়ে আমি তীর্থে যেতে চাই”। ছেলেরাও বাবাকে জানায় যে তারা তার বিশ্বাসের কোনরূপ অমর্যাদা করবে না।

এদিকে বৃন্দাবনী এখন পনেরো বছরের যুবতী। তার যৌবন টলমল করছে বটে, কিন্তু সভ্য সমাজের থেকে সে অবহেলিত। নিজের জীবনের দুঃখ চিরসঙ্গী জেনেও নিরন্তর নিজের মতো করে বাঁচার চেষ্টা করে সে। কেউ-কেউ তাকে ‘হিজরে মাসি’ বলে ব্যঙ্গ করে। তাতে প্রথম-প্রথম খুব কষ্ট হতো বৃন্দাবনীর। কিন্তু যত দিন যায় ততই গা সওয়া হয়ে যায় ব্যাপারটা। শেষমেশ ‘হিজরে মাসি’দের দলেই নাম লেখায় সে। পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে যা পাওয়া যায় তাতে তার মাসে কুড়িহাজার টাকার বেশি রোজগার হয়। খাওয়া-পরার অভাব না থাকলেও জীবনের অধিকাংশ সুখ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় মাঝে-মাঝে খুব কষ্ট হয় বৃন্দাবনীর। তার দলের বদন হিজরে, রূপসী হিজরে, ফাল্গুনী হিজরে তাকে খুব ভালবাসে। দলে সকলেই বয়সে তার চেয়ে বড় হওয়ায় তাকে স্নেহ করে সকলে।

বৃন্দাবনী জন্মাবার পর যেহেতু তাকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসা হয়েছিল, সেহেতু নিজের বংশ পরিচয় কিছুই জানে না সে। বাবা-মা’র অভাব মাঝেমধ্যেই অনুভব করে, কিন্তু অন্য মাসিরা সে অভাব খানিক ভুলিয়ে দেয়। একমাত্র শ্যামা ছোটবেলা থেকেই বৃন্দাবনীর খোঁজ নিত। যখন তার বাবা বৃন্দাবনীকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে এসেছিলেন, তখন শ্যামা পিছন-পিছন গিয়ে সেটি দেখে ফেলে; তাই বৃন্দাবনীকে একমাত্র শ্যামা-ই চেনে। হিজরে মাসিদের সমাজে আসার পর শ্যামা তার স্বামীকে নিয়ে দু’বার বৃন্দাবনীকে দেখতে এসেছিল। নিজের পরিচয় দেয়নি, পাছে সে কষ্ট পায়। স্বামীকে বিয়ের পরে সব কথা জানিয়েছিল শ্যামা।

এদিকে দীপঙ্করবাবু হরিদ্বারে তীর্থ করতে যাওয়ার সুযোগে অরুময় ও রাধেময় নিজেদের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেন, এবং বোনকে ফাঁকি দিয়ে বাবার গোটা সম্পত্তি নিজেদের নামে করিয়ে নেন। এখানে বলা প্রয়োজন, দীপঙ্করবাবু অশিক্ষিত হওয়ায়, একদিন খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে সরকারি স্ট্যাম্প পেপারে টিপ সই করিয়ে নিয়েছিলেন অরুময় ও রাধেময়। দীপঙ্কর রায় বাড়ি ফেরার পর সবকিছু জেনে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পড়ে গিয়ে তার মাথা ফেটে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। খবর পেয়ে শ্যামা ও তার স্বামী আসেন তাদের বাড়িতে। এদিকে পাড়ার লোকে দীপঙ্করবাবুকে নিয়ে যান হাসপাতালে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে ‘ও-নেগেটিভ’ রক্তের প্রয়োজন দেখা দেয়। শ্যামা ও তার স্বামীর রক্ত ‘ও-নেগেটিভ’ না হওয়ায় চিন্তায় পড়ে যায় সবাই। ডাক্তার বলেছেন— একঘণ্টার মধ্যে রক্ত না দিলে বাবাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। সেই কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে শ্যামা।

হঠাৎ করে শ্যামার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। সত্বর হিজরে মাসিদের পল্লীতে গিয়ে বৃন্দাবনীর সঙ্গে দেখা করে সমস্তটা খুলে বলল সে। বৃন্দাবনীর প্রথমটায় বাবার ওপর ভীষণ রাগ হয়েছিল, কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভেবে দেখল বাবাকে এ-যাত্রায় বাঁচাতে না পারলে কোনদিন সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।

দীপঙ্করবাবুর অজান্তেই বৃন্দাবনীর রক্তে সেদিনের মতো মরতে-মরতে বেঁচে গেলেন তিনি। যখন জ্ঞান ফিরল তখন তার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বৃন্দাবনী, শ্যামা ও শ্যামার স্বামী। শ্যামা তার বাবাকে বৃন্দাবনী সম্পর্কে সব খুলে বলল। দীপঙ্করবাবুর লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে। তিনি বুঝতে পারেন, যে বৃন্দাবনীর ওপর তিনি এত বড় অন্যায় করেছেন, সে-ই আজ তার প্রাণ বাঁচিয়েছে। এই অসময়ে তার ‘গর্বে’র ছেলেরা একবারের জন্যও এগিয়ে আসেনি। বৃন্দাবনী চলে যাওয়ার সময় বাবাকে উদ্দেশ্য করে শ্যামাকে বলল, “তুমি বললে তাই আমি এখানে এলাম, নতুবা আমি কখনও আসতাম না। সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে, সে সন্তানই হয়। বাবা-মা’র প্রতি কর্তব্যই প্রমাণ করে দেয় সে সুসন্তান, না কুসন্তান। মেয়েরা পারে না এমন কিছু নেই। আর আমার মত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও তো বাবা-মাই জন্ম দেয়। তাহলে ঈশ্বর সৃষ্ট সেই সন্তানের কি দোষ বল তো দিদি?” আমরাও তো মানুষ। এই কথা বলতে-বলতে বৃন্দাবনীর চোখের কোণে জল চিকচিক করে ওঠে। বৃন্দাবনীর বাবা সকলের সামনে বৃন্দাবনীর কাছে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। বৃন্দাবনী বাবাকে ক্ষমা করেছিল কিনা জানা নেই, তবে তার প্রতি অভিমান করে নিঃশব্দে হাসপাতাল থেকে হিজরে পল্লীর দিকে পা বাড়িয়েছিল।

Tagged with: , ,