অলিম্পিকস্‌— ধর্ম থেকে ক্রীড়া

অয়ন চট্টোপাধ্যায়

Posted On: July 22, 2021

অলিম্পিক গেমসের ইতিহাস— মোটেই কোন সামান্য বিষয় নয়। একটি প্রতিযোগিতা, যাকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে রয়েছে নানা ধর্ম জাতি বর্ণের মানুষ, তাদের আচার-আচরণ, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি— আরও কত কি! বিশ্বের জনপ্রিয়তম ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ৩২তম সংস্করণ সূচনার প্রাককালে তাই সেই বিচিত্র ইতিহাস নিয়ে আলোচনার লোভ সংবরণ করতে না পেরে অগত্যা বসে পড়লাম কলম নিয়ে। তবে মূল বিষয়ে প্রবেশের আগে এই বেলা আমার কৃতজ্ঞতা জানাই নিম্নলিখিত বইগুলির লেখক এবং সম্পাদকদের প্রতি, যেগুলি তথ্যসূত্র হিসেবে ধরা না দিলে হয়ত এ লেখার সিকিভাগও হয়ে ওঠা সন্দেহের ছিল— ১) Historical Dictionary of the Modern Olympic Movement (1996); John E. Findling, Kimberly D. Pelle।
২) An Approved History of the Olympic Games (1984); Bill Henry।
৩) THE OLYMPICS — A History of the Modern Games (1992); Allen Guttmann।

আনুমানিক প্রায় তিন হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রীসে উদ্ভূত অলিম্পিক গেমস উনিশ শতকের শেষদিকে পুনরূজ্জীবিত হয় এবং বর্তমানে তা বিশ্বের অন্যতম একটি শীর্ষস্থানীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় উন্নীত হয়েছে। খ্রীস্টপূর্ব অষ্টম শতক থেকে খ্রীস্টাব্দ চতুর্থ শতক পর্যন্ত, প্রাচীন গ্রীক দেবতা জিউসের উপাসনাকে কেন্দ্র করে প্রতি চার বছর অন্তর গেমস্‌ অনুষ্ঠিত হতো পশ্চিম পেলোপনিজ উপদ্বীপে অবস্থিত অলিম্পিয়া শহরে। প্রথম আধুনিক অলিম্পিকস্‌ অনুষ্ঠিত হয় ১৮৯৬ সালে, এথেন্সে।

বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতে প্রাচীন অলিম্পিক গেমসের প্রথম যে লিখিত রেকর্ডটি পাওয়া গিয়েছে তা হল ৭৭৬ খ্রীস্টপূর্বাব্দের, যেখানে করিয়োবাস নামে প্রাচীন গ্রীসের এলিস শহরের এক রাঁধুনির সেই অলিম্পিকের একমাত্র প্রতিযোগিতা ‘স্টেড্‌’ (যে শব্দ থেকে পরবর্তীকালে ‘স্টেডিয়াম’-এর উৎপত্তি) বা দৌড় প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যায়। তবে অনেকেই মনে করেন যে অলিম্পিক ৭৭৬ খ্রীস্টপূর্বাব্দের বেশ কিছুকাল আগে থেকেই চালু ছিল। আবার জনশ্রুতি অনুযায়ী— দেবতা জিউস ও অ্যালকামিনের পুত্র হেরাকলস (রোমান হারকিউলিস) প্রথম অলিম্পিক গেমস্‌ চালু করেছিলেন।

খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের শেষদিকে সমস্ত গ্রীক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলির মধ্যে অলিম্পিকই সবচাইতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। প্রতি চার বছর অন্তর ৬ আগস্ট থেকে ১৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেবতা জিউসের আরাধনা চলাকালীন অনুষ্ঠিত হতো অলিম্পিক। এর নামকরণ করা হয় দক্ষিণ গ্রীসের পেলোপনিজ উপদ্বীপের পশ্চিম উপকূলের নিকটে অবস্থিত পবিত্র স্থান, ‘অলিম্পিয়া’ শহরের নাম থেকে। উপরোক্ত জনশ্রুতির প্রভাব এতটাই তীব্র ছিল যে প্রাচীন ঐতিহাসিকরা পরবর্তী সময়ে অলিম্পিকগুলির মধ্যে চার বছরের ব্যবধানের মাধ্যমে বছরের হিসেবও শুরু করেছিলেন।

১৩টি অলিম্পিকের পরে আরও দু’টি দৌড় প্রতিযোগিতা এর অন্তর্ভুক্ত হয়— ডায়ালোস (বর্তমানে যা প্রায় ৪০০ মিটার দৌড়ের সমান) এবং ডলিচোস (লং রান)। এছাড়াও পেন্টাথলন (পাঁচটি খেলার সমন্বয়— দৌড়, লং জাম্প, ডিস্কাস থ্রো, জাভলিন থ্রো এবং কুস্তি) শুরু হয় ৭০৮ খ্রীস্টপূর্বাব্দে, বক্সিং শুরু হয় ৬৮৮ খ্রীস্টপূর্বাব্দে এবং রথের দৌড় শুরু হয় ৬৮০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে। ৬৪৮ খ্রীস্টপূর্বাব্দে বক্সিং ও কুস্তির সংমিশ্রণে ‘প্যাঙ্ক্রেশন’ নামের একটি প্রতিযোগিতা চালু হয়, যেখানে কার্যত কোন নির্দিষ্ট নিয়মই ছিল না। প্রাচীন অলিম্পিক গেমসে কেবলমাত্র গ্রীসের পুরুষ নাগরিকরাই অংশগ্রহণের অধিকার পেয়েছিলেন; কোনওরূপ মহিলাদের প্রতিযোগিতা এর অন্তর্ভুক্ত ছিল না এবং বিবাহিত মহিলাদের অংশগ্রহণে কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিল।

খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগে রোমান সম্রাট গ্রীস অধিকার করার পরেও অলিম্পিক গেমস্‌ অব্যাহত ছিল, তবে সার্বিকভাবে তার মান হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। এই বিষয়ে উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় ঐতিহাসিকদের লেখায়— ৬৭ খ্রীস্টাব্দের অলিম্পিকে রথের দৌড় প্রতিযোগিতায় রোমান সম্রাট নেরো মদ্যপ অবস্থায় অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং স্বাভাবিকভাবেই প্রতিযোগিতা চলাকালীন রথ থেকে তিনি পড়ে যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্রাট নেরোকেই সেই প্রতিযোগিতার বিজয়ী ঘোষণা করা হয় তার প্রতি আনুগত্য পোশনের উদ্দেশ্যে। এইভাবে চলতে-চলতে ৩৯৩ খ্রীস্টাব্দে খ্রীস্ট ধর্মাবলম্বী সম্রাট প্রথম থিয়োডোসিয়াস প্রায় বারো শতক ধরে চলে আসা সমস্ত ‘পৌত্তলিক’ উৎসবগুলিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার সঙ্গে-সঙ্গেই প্রাচীন অলিম্পিকের পতন হয়।

প্রাচীন অলিম্পিকের পতনের পর কেটে গিয়েছে আরও দেড় হাজার বছর; পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে সমাজব্যবস্থা, দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রেই। মানুষ নিরন্তর পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে রচনা করেছে নতুন-নতুন ইতিহাস। ইউরোপে ঘটে গিয়েছে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ। এমতাবস্থায় ফ্রান্সের ব্যারন পিয়র দি কৌবার্টিনের (১৮৬৩-১৯৩৭) প্রচেষ্টায় অলিম্পিক গেমসের পুনরুদ্ধার হয়। তরুণ যুবক ব্যারন ছিলেন দেহচর্চা শিক্ষার প্রসারে বিশেষ উদ্যোগী। তিনি প্রাচীন অলিম্পিকের ঘটনাস্থল অলিম্পিয়া শহর ঘুরে দেখেন এবং তখনই মাথায় আসে তাঁর আধুনিক অলিম্পিক গেমসের ভাবনা। ১৮৯২ সালের নভেম্বর মাসে প্যারিসে ‘ইউনিয়ন ডেস স্পোর্টস্‌ অ্যাথলেটিক্স’-এর একটি সভায় কৌবার্টিন আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতা হিসেবে প্রতি চার বছর অন্তর অলিম্পিক গেমস্‌ পুনরায় চালু করার প্রস্তাবনা পেশ করেন। তার ঠিক দেড় বছরের মাথায়, ১৮৯৪ সালে তিনি ‘ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি’ বা IOC গঠনের অনুমোদন লাভ করেন এবং সেই বছরেই ২৩ জুন গঠিত হয় IOC, যা বর্তমানেও অলিম্পিকের প্রধান পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব পালন করে চলেছে।

১৮৯৬ সালে গ্রীসের এথেন্সে প্রথম আধুনিক অলিম্পিকের আসর বসে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাজা প্রথম জর্জ এবং ষাট হাজার দর্শকের উন্মাদনা স্বাগত জানায় ১৩টি দেশের মোট ২৮০জন প্রতিযোগীকে, যারা ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড, জিমন্যাস্টিক্স, সাঁতার, কুস্তি, সাইক্লিং, টেনিস, ভারোত্তলন, শুটিং ইত্যাদি সমেত মোট ৪৩টি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেন। তবে সেই অলিম্পিকে কোন মহিলাকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়নি। ১৮৯৬-এ অলিম্পিকের পুনর্জন্মলগ্নেই জন্ম হয় বিখ্যাত ‘ম্যারাথন’ দৌড়ের। ৪৯২ খ্রীস্টপূর্বাব্দে পারস্যের প্রথম গ্রীস আক্রমণের পর ৪৯০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে ‘ম্যারাথনের যুদ্ধে’ গ্রীসের জয়ের খবর পৌঁছে দিতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে গ্রীক দূত ফিলিপিডিস (মতান্তরে ফেইডিপিডিস) এথেন্সে পৌঁছন ২৫ মাইল পথ দৌড়ে। যদিও এই বিষয়ে পরবর্তীকালে বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি হয়। যেমন, গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস-এর বক্তব্য অনুযায়ী, ফিলিপিডিস আসলে এথেন্স থেকে স্পার্টা দৌড়ে পৌঁছেছিলেন যুদ্ধে আরও সামরিক সহায়তা প্রার্থনা করতে এবং আবার একই পথে যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে গিয়েছিলেন মোট প্রায় ২৭০ মাইল অতিক্রম করে। তবে বহুল প্রচলিত কাহিনির ভিত্তিতেই, কিছুটা ফিলিপিডিসের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং আধুনিক অলিম্পিকের একটা নিজস্বতা সৃষ্টির হেতু ফ্রেঞ্চ ভাষাবিজ্ঞানী মিচেল ব্রিঁলের মস্তিষ্কপ্রসূত ‘ম্যারাথন দৌড়’ চালু হয় ১৮৯৬ অলিম্পিকস্‌-এ, যা পরবর্তীকালে অলিম্পিকস্‌ ছাড়াও আরও বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে ওঠে।

গ্রীসের স্পাইরিডন লুইস ২ ঘন্টা ৫৮ মিনিট ৫০ সেকেন্ডে ২৫ মাইল অর্থাৎ প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে প্রথম ম্যারাথনে স্বর্ণপদক লাভ করেন। তবে ফিলিপিডিসের ২৫ মাইল দৌড়নোর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৮৯৬ অলিম্পিকে ম্যারাথন দৌড়ের দূরত্ব ২৫ মাইল করা হলেও তার পরের কয়েকটি অলিম্পিকে সেই দূরত্ব আর বজায় রাখা সম্ভব হয়নি— কখনও তা ২৫ মাইলের কম ২৪.৮৫-ও যেমন হয়েছে, আবার কখনও তা ছাড়িয়ে গিয়েছে ২৬.৫-এর কাঁটাও। শেষমেশ ১৯২৪-এ ম্যারাথনের নির্দিষ্ট দূরত্ব স্থির হয়ে দাঁড়ায় ২৬.২২-এ, যা প্রায় ৪২ কিলোমিটারের সমান।

আধুনিক অলিম্পিকের অফিশিয়াল লোগো হল পাঁচটি ইন্টারলকিং রঙিন রিং, যা আমাদের পাঁচটি মহাদেশ— উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ এবং ওশিয়ানিয়াকে চিহ্নিত করে। সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডের মাঝখানে পাঁচটি রঙিন রিং— অলিম্পিকের বিখ্যাত পতাকাটি প্রথমবার উত্তোলিত হয় ১৯২০ সালের অ্যান্টওয়ার্প গেমসে।

আধুনিক অলিম্পিক যথার্থই একটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পরিণত হয় ১৯২৪ সালে, প্যারিসে আয়োজিত অষ্টম সংস্করণে। সেই বার ৪৪টি দেশের মোট প্রায় ৩০০০ অ্যাথলিট (যার মধ্যে ১০০ জনেরও বেশী মহিলা) বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যোগদান করেছিলেন। আর সেই অলিম্পিকেই প্রথম ‘সমাপ্তি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আবার সেই একই বছরে প্রথমবার শীতকালীন অলিম্পিকস্‌ অনুষ্ঠিত হয় ফ্রান্সের চামোনিক্স শহরে। ফিগার স্কেটিং, আইস হকি, ববস্লেডিং এবং বায়থলনের মতো প্রতিযোগিতা অন্তর্ভুক্ত হয় এই শীতকালীন অলিম্পিকসের। এর ঠিক আশি বছর পরে, ২০০৪ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকস্‌ এক শতকেরও বেশী সময় পর পুনরায় অনুষ্ঠিত হয় এথেন্সে, যেখানে ২০১টি দেশ থেকে মোট প্রায় ১১,০০০ অ্যাথলিট বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেইবার অলিম্পিক গেমসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রাচীন ও আধুনিক অলিম্পিকের ঐতিহ্যের মধ্যে সমন্বয়কারী ‘শটপুট থ্রো’ প্রতিযোগিতাটির আয়োজন করা হয়েছিল প্রাচীন অলিম্পিকের ঘটনাস্থল অলিম্পিয়া শহরেই।

এইরকম আরও নানা রঙিন, বিচিত্র সব ঘটনার মধ্যে দিয়েই এগিয়ে চলেছে অলিম্পিকের জয়যাত্রা। টুকরো-টুকরো ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়ের ঐতিহাসিকদের গবেষণায়, সব ক’টি এক জায়গায় করে লেখা দীর্ঘায়িত করার বাসনা তাই ত্যাগ করতেই হয়। আপাতত আগামীর দিকে তাকিয়ে আমরা সবাই— করোনা অতিমারির জেরে বিলম্বিত ২০২০ অলিম্পিকস্‌ অবশেষে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির ১২৫তম অধিবেশনে নির্ধারিত অকুস্থল জাপানের টোকিও-তে, আগামী ২৩ জুলাই, ২০২১ থেকে ৮ অগস্ট, ২০২১ পর্যন্ত। জাপান ১৯৬৪-র পর দ্বিতীয়বার অলিম্পিকস্‌ আয়োজন করার সুযোগ পেয়েছে। আসন্ন অলিম্পিকসে করোনা অতিমারির কারণে উত্তর কোরিয়া কোনোরূপ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। IOC-এর অন্তর্ভুক্ত অবশিষ্ট ২০৫টি দেশ থেকে মোট ১১,২৫১ জন অংশগ্রহণ করতে চলেছেন ৩৩ প্রকার খেলায় মোট ৩৩৯টি ইভেন্টে। ভারত থেকে ১৮টি খেলায় মোট ১২৬ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করতে চলেছেন আসন্ন অলিম্পিকে।

ছবি- ইন্টারনেট

Tagged with: , ,