দুই বুড়োর ঘোরাঘুরি

রাহুল মজুমদার

Posted On: August 1, 2021

গোমুখে দুই গোমুখ্যু

অক্টোবরের শেষ। গঙ্গোত্রীতে মারকাটারি ঠান্ডা। মন্দির বন্ধ হতে মাত্র ক-দিন বাকি। সাতটার আগেই চা, আলু-পরোটা খেয়ে সব জাব্বাজোব্বা চাপিয়ে দাঁতের কত্তাল বাজাতে-বাজাতে দুই বুড়ো মন্দির চত্বরে সাত সেকেন্ডের স্টপেজ দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে জিভ বুকে ছুঁইয়ে গোমুখ যাওয়ার পথে উঠে এলো। পথের ওপর ঝুঁকে পড়ে গাছেরা বেশ কিছুক্ষণ সঙ্গ দিল। গঙ্গোত্রী সংরক্ষিত উদ্যানে ঢুকে পড়ার পর তারা সরে দাঁড়াল। পথে এখন মাটির চেয়ে পাথর বেশি। শেষ হেমন্তের রং মেখে ঝোপঝাড়েরা পথের দু’ধারে। বাঁদিকে পাহাড় সোজা উঠে আকাশ ছুঁয়েছে। ডানদিকে আবার রংবেরঙের ঝোপের ঝরনা গড়াতে গড়াতে ভাগীরথীর সঙ্গে আলাপ করতে নেমে গেছে। মোটামুটি সোজাসাপ্টা পথ। দুই বুড়ো দিব্যি চলেছে। ডানদিক থেকে অনেকক্ষণ নজর রেখে শেষমেশ হাল ছেড়ে দিল গঙ্গোত্রী থেকে সঙ্গ দেওয়া সুদর্শন শৃঙ্গ। এবার দু’ধারে নিঃশব্দ পাহাড়। মাঝে আপনমনে নাচতে গাইতে চলেছে ভাগীরথী। যত এগোচ্ছে দুই বুড়ো, ততই গাছপালা ঝোপঝাড় কমছে, পাথর বাড়ছে। বেলা গড়িয়ে দুপুরকে পিছনে ফেলে দিল। পেটে বিসর্জনের বাজনা বেশ জোরেই বাজতে আরম্ভ করেছে। পথে এখন শুধুই বোল্ডার। এইরকমই একটা দেড়তলা সমান বোল্ডারের স্তূপের মাথায় চড়ে সামনে হঠাৎই চীর গাছের বন পেয়ে দুই বুড়ো বুঝল,চীরবাসা পৌঁছে গেছে। পলিথিনের অস্থায়ী দোকান কাম চটীর অদ্যই শেষ রজনী। বিছানার দেখা পেয়ে দুই আলসে বুড়োই বডি ফেলে দিল। সুয্যি ডুবতেই ঠান্ডা রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সব গরমজামা চাপিয়েও ঠিক জুত হচ্ছে না। হিমশীতল অন্ধকারে দুই চটীমালিক আর দুই বুড়ো চাদ্দিক ঢাকাঢুকি দিয়ে সোলার টর্চ আর লম্ফ-র আলোয় ‘ডিনার’ সেরে লেপের তলায় ঢুকে পড়ল। পরদিন আলো ফুটতেই দুই বুড়ো ভুজবাসার পথে জোর হাঁটা লাগাল।কুখ্যাত গিলাপাহাড়ের অঞ্চল পাথর গড়ানো আরম্ভ হওয়ার আগেই পেরিয়ে যেতে হবে। ইতিমধ্যেই সকালের আলো মেখে ভাগীরথী বোনেরা সহাস্যবদনে দেখা দিয়েছে। ডানদিকে ভৃগু শৃঙ্গও অভয় দিচ্ছে। তার জোরেই বোধহয় জায়গাটা পেরিয়ে গেল দুই বুড়ো। পিছন ফিরে গিলাপাহাড়ের ভয়ঙ্কর রূপ দেখে একবার শিউরে নিয়ে আরও জোরে পা চালাল। কিছুক্ষণ পরেই নিচে ভাগীরথীর ধারে ভুজবাসা দেখা দিল। বহুদিন ধরে শুনে আসা আতিথেয়তার স্বপ্ন লালবাবার আশ্রমে এসে চুরমার হয়ে গেল। বাধ্য হয়েই জি এম ভি এন-এর বাংলোয় উঠল দুই বুড়ো। দুপুরের খাবার খেয়ে দেড়টা নাগাদ আবার বেরিয়ে পড়ল— গোমুখ দেখে সন্ধে নামার আগেই ফিরে আসবে এখানে। এবার পথ বলতে শুধুই বোল্ডার। ছোট বড় নানান সাইজের। তাদের বেশির ভাগই বড্ড স্বাধীনচেতা; পা দিলেই নড়েচড়ে ফেলে দিতে চায়।আস্তে-আস্তে ভাগীরথীর অধিত্যকা চওড়া হচ্ছে। ডানদিকে মাথা তুলে দুই বুড়োকে দেখে নিচ্ছে শিবলিঙ্গ। ভাগীরথী শৃঙ্গরা তো দু’হাত বাড়িয়েই আছে। তপোবন যাবার পথকে বাঁয়ে রেখে দুই বুড়ো নেমে এলো ভাগীরথীর ধারে। একটু আগেই গোমুখের বিশাল চাঙড় ভেঙে পড়ার বিকট শব্দ কানে এসেছে। তাই খানিক তফাত থেকেই গোমুখ দর্শন সারল দুই বুড়ো। আধঘন্টা সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখে ফেরার পথে যে কতবার পিছন ফিরে ফিরে দেখেছে দুই বুড়ো, তার ইয়ত্তা নেই। ওদের এই আচরণে খুশি হয়েই বোধহয় শেষবেলায় ভাগীরথী বোনেরা তাদের কনে দেখা আলোর সাজ দেখিয়ে ওদের জীবন সার্থক করল। দুই গোমুখ্যু বুড়ো গোমুখ দর্শনের আনন্দ বুকে নিয়ে শুতে গেল।

ফটো: লেখকের সৌজন্যে

Tagged with: