নির্মাণ আর সৃষ্টি : রবীন্দ্রগ্রন্থ

আশিস পাঠক

Posted On: June 5, 2021

রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত বই কবি-কাহিনী৷ প্রকাশক প্রবোধচন্দ্র ঘোষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধু৷ রবীন্দ্রনাথ তখন আমদাবাদে, মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে৷ তখনই তাঁর ‘উৎসাহী বন্ধু’ প্রবোধচন্দ্র ঘোষ বইটি ছাপিয়ে তাঁর কাছে পাঠিয়ে তাঁকে অবাক করে দেন৷

যখন-তখন বই ছাপানোয় রবীন্দ্রনাথের বরাবর আপত্তি ছিল৷ এমনকী, রচনাবলিতেও সব লেখা ছাপিয়ে মেহগনির মঞ্চ-ভরানো পঞ্চ হাজার গ্রন্থের লেখক তিনি হতে চাননি৷ সুতরাং কাজটাকে তিনি ভাল মনে নেননি৷ একটু মজা করেই লিখেছেন জীবনস্মৃতি-তে, ‘তিনি যে কাজটা ভালো করিয়াছিলেন তাহা আমি মনে করি না, কিন্তু তখন আমার মনে যে-ভাবোদয় হইয়াছিল, শাস্তি দিবার প্রবল ইচ্ছা তাহাকে কোনোমতেই বলা যায় না। দণ্ড তিনি পাইয়াছিলেন, কিন্তু সে বইলেখকের কাছে নহে— বই কিনিবার মালেক যাহারা তাহাদের কাছ হইতে।’

বই সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের খুব বাড়াবাড়ি রকমের মোহ ছিল না কোনও দিনই৷ বাঙালির বই নিয়ে বাড়াবাড়ির একটা বড় অংশ যে-গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের বই ঘিরে তিনিও একদিন বইয়ের মোহ আবরণটি ঘুচিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন৷ ‘আবরণ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘বই পড়াটাই যে শেখা, ছেলেদের মনে এই অন্ধসংস্কার যেন জন্মিতে দেওয়া না হয়৷ প্রকৃতির অক্ষয় ভাণ্ডার হইতেই যে বইয়ের সঞ্চয় আহরিত হইয়াছে, অন্তত হওয়া উচিত, এবং সেখানে যে আমাদেরও অধিকার আছে, এ কথা পদে পদে জানানো চাই৷’ এই জানানোর কাজটা আজও এ দেশে সে ভাবে হয়ইনি৷ আজও বইয়ের উপর নির্ভরশীলতা আমাদের প্রবল, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছিলেন মানসিক নবাবি৷ ইন্টারনেট এই নবাবিটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে৷ তুচ্ছ বিষয়টুকুর জন্যও বই না হলে আমাদের মন আশ্রয় পেত না, এখন তার জন্য গুগল করলেও চলে৷ আর আসলে বিশ্বাসটা যেহেতু মুদ্রিত অক্ষরের উপরে তাই উইকিপেডিয়া-কে নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে এমনকী অ্যাকাডেমিক গবেষণাতেও উদ্ধৃত করতে দেখেছি৷

অথচ, আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষার বাহন হিসেবে বইয়ের চেয়ে আরও অনেক বেশি বিশ্বস্ত, বেশি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম আমাদের দিয়েছে৷ চলমান জগৎকে এখন তার ছবি আর শব্দ-সহ রেকর্ড করে ফেলা যায়৷ কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এর ব্যবহার এখনও ভয়ংকরভাবে সীমিত৷ আধুনিক ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলগুলোয় পাঠ্য বইয়ের সঙ্গে দৃশ্য ও শ্রাব্য সিডিও দেওয়া হয় বটে, কিন্তু তার সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন জনসংখ্যার কত শতাংশ? ফলে এখনও বইই আমাদের পরম বিশ্বাসের বস্তু৷ আর জগৎকে বই দিয়ে ছোঁয়ার সেই অভ্যেস এমনই মারাত্মক যে রামমোহন লাইব্রেরিতে শ্বেতপাথরে খোদাই করে আজও লেখা থাকতে দেখি রবীন্দ্রনাথের সেই ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধের উদ্ধৃতি, যে প্রবন্ধে গ্রন্থাগারকে জেলখানার সঙ্গে তুলনা করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘এখানে…মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে৷’

শান্তিনিকেতন প্রেস বা বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব বই-তৈরির ইতিহাসে বই তাই একটা ‘মধ্যস্থ’ পদার্থ মাত্র, যা ক্রমেই লুপ্ত হতে চায়৷ বইয়ের বিষয় এবং তার মুদ্রণে ক্রমেই একটা নিজস্ব চরিত্র অর্জন করতে চাইছিল শান্তিনিকেতন প্রেস, প্রথাগত ‘ইউনিভার্সিটি প্রেস’-এর ধারণা থেকে যা আলাদা৷ ভারতবর্ষে কেন, সারা পৃথিবীতেই বোধহয় এমন কোনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস নেই যার প্রথম মুদ্রিত বইটি গানের বই৷ অথবা, এমন কোনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা নেই যার প্রথম বই একটি নাটক৷ কিন্তু শান্তিনিকেতন প্রেসে প্রথম ছাপা বই গীত-পঞ্চাশিকা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগের (তখন ‘গ্রন্থালয়’) প্রথম বই, শান্তিনিকেতন প্রেসেই মুদ্রিত, রবীন্দ্রনাথের ‘বসন্ত’৷ ১৯১৮-য় শান্তিনিকেতন প্রেস আর ১৯২৩-এ বিশ্বভারতী গ্রন্থালয় প্রতিষ্ঠার আগেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনার একটা আন্তর্জাতিক মানের ধারা তৈরি হয়ে গিয়েছে৷ কেম্ব্রিজ, অক্সফোর্ড, প্রিন্সটন বা হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস তখন প্রতিষ্ঠিত৷ তাদের কোনওটিকেই আদর্শ না করে সম্পূর্ণ নিজের মতো চলতে শুরু করেছিল রবীন্দ্রনাথের ছাপাখানা৷ শুধু মনন আর পাণ্ডিত্যের চর্চা নয়, খোলা মাঠের খেলায় সৃজনের অবসরে বেড়ে ওঠা সেই পথের বৈশিষ্ট্য৷

বই তৈরির ক্ষেত্রেও একটা নিজস্ব চারিত্র্য আনতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ এক ছাঁচে ঢালা মুদ্রিত হরফের মধ্যে এক ধরনের যান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ বার বার দেখেছিলেন৷ গ্রন্থাগারকে জেলখানার সঙ্গে তুলনা করে ওই যে বলেছিলেন, ‘এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে,’ সেই জেলখানায় একটু ব্যক্তিগত অবসর আনার জন্যই বোধহয় বইয়ের প্রচ্ছদে হাতের লেখায় বইয়ের নাম ছাপা হয়, জার্মানির প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় ‘লেখন’ পুরোটাই হাতের লেখায় ছাপার জন্য৷ তারই তাগিদে হয়তো বইয়ের প্রচ্ছদে রইল অতখানি খোলা জমি, স্পেস৷ আর তার তুলনা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এলেন প্রাচ্যেরই নিরাসক্ত সংযমের কথা, ‘মলাটে সাদা অক্ষরে বীথিকা যেন লেখা থাকে, আমি অলঙ্কৃত করে দেবো না৷…নিজের বই সম্বন্ধে নতুন লেখকের গদগদ স্নেহের সোহাগ এতে প্রকাশ পায়৷ জাপানীরা তলোয়ারে কারুকার্য্য করে, খাপ রাখে অত্যন্ত সাদা…৷’

বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের বইপত্রের প্রচ্ছদেও তাই খোলা মাঠের খেলা৷ মাধ্যমের উচ্চকিত উপস্থিতিটাকে যতটা সম্ভব মৃদু করতে চাওয়া হয়েছে গ্রন্থনবিভাগের বইপত্রে, সেটাই তার নিজস্ব ধারা৷ ঠিক এই সরলতার দিকে যাত্রা ছিল রবীন্দ্রনাথের অলংকরণ-ধারণাতেও৷ বস্তুত ঠিক এই বিন্দুতেই নন্দলাল বসু রবীন্দ্ররচনার অলংকরণে এক স্বয়ংসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেন৷ সাহিত্যের চিত্ররূপের যে মোহ আবরণ তা একটু একটু করে খসিয়ে ফেলে এক সরল নবীনতার দিকে যাত্রা করুক অলংকরণ এমনটাই চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ ঠিক এই ভাষায়, এই ভাবে কথাগুলো বলেননি কখনও রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু তাঁর সংশ্লিষ্ট চিঠিপত্র খুব মন দিয়ে পড়লে বোঝা যায় অলংকরণ তথা সামগ্রিক ভাবে চিত্রশিল্প সম্পর্কেই তাঁর আশার গতিপ্রকৃতিটা ঠিক কেমন৷ ৮ মে ১৮৯৩-এ ইন্দিরা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘রবিবর্মার ছবি দেখতে দেখতে সমস্ত সকালবেলাটা গেল৷ আমার সত্যি বেশ লাগে৷ হাজারই হোক, আমাদের দিশি বিষয় এবং দিশি মূর্তি ও ভাব আমাদের কাছে যে কতখানি, এই ছবিগুলি দেখলে তা বেশ বোঝা যায়৷ অনেকগুলো ছবির হাত পা, দেহের পরিমাণ, খুব অসমান আছে, কিন্তু মোটের উপর সবসুদ্ধ জড়িয়ে খুব মনের ভিতরে প্রবেশ করে৷ তার প্রধান কারণ, আমাদের মনটা চিত্রকরের সহযোগিতা করতে থাকে৷ সে কী বলতে চাচ্ছে আমরা আগে থাকতে বুঝে নিই—তার চেষ্টাটুকু দেখলেই বাকিটুকু পূরণ করে নিতে পারি৷ এর ভিতর থেকে খুঁত বের করা খুব সহজ, তার জন্যে বেশি ক্ষমতার দরকার নেই, কিন্তু যখন ভেবে দেখা যায় কোনো বিষয়ে একটা স্পষ্ট কল্পনা করা কতই শক্ত—মনে আমাদের যে ছবিটা উদয় হয় তা প্রায়ই আধা-আধি, মোটামুটি গোঁজা-মিলন-দেওয়া—কিন্তু ছবি আঁকতে গেলে একটি সামান্যতম রেখা পর্যন্ত ছাড়বার যো নেই, প্রধান অপ্রধান সমস্তই একেবারে যথাযথ করে ভেবে নিতে হবে, কল্পনার মতো অমন একটা নিয়তপরিবর্তমান জিনিষকে প্রত্যক্ষের কঠিন ছাঁচে ঢেলে দিতে হবে—সে কি সামান্য ব্যাপার!’ (ছিন্নপত্রাবলী ১৪৬) এর প্রায় ৪৫ বছর পরে, ১৭ মে ১৯৩৭ নন্দলাল বসুকে লিখছেন, ‘তুমি আমাকে যে ছাগলের ছবি পাঠিয়েছ এ উর্বশীর সহোদর ভাই নয় কিন্তু এর বাসা অমরাবতীতে৷ এর থেকে প্রমাণ হয় আর্টে সুন্দর হবার জন্যে সুন্দর হবার কোনো দরকার হয় না৷ আর্টের কাজ মন টানা, মন ভোলানো নয়৷’

অর্থাৎ, অবিকল চিত্ররূপে রবীন্দ্রনাথের কোনও বিশ্বাস নেই, পাঠক-দর্শকের কল্পনাকে স্পেস দিতে চান তিনি৷ এই স্পেস-কে জায়গা হয়তো বলা যায়, কিন্তু আমি একে অবসর বলতে চাই৷ রচনাকে ভালবাসবার অবসর৷ কথার মধ্যে, কালো কালো অক্ষরের শৃঙ্খলের মধ্যে যেমন বিটুইন দ্য লাইন্স ভালবাসিবার অবসর তেমনই তো ছবিতে৷ সমস্তটাই যদি এঁকে দেওয়া হয় বেশ জমকালো নাটকীয়তায় তবে সেই অবসরটা আর থাকে না৷ রবীন্দ্রনাথের শব্দ কিংবা চিত্র দুই শিল্পযাত্রায়ই তো সেই অবসরের সন্ধান৷ কথা কেটে কেটে ছবি তৈরি করেন যিনি তিনিই একসময় পৌঁছে যান রূপের অতীতে এক সম্পূর্ণ নিজস্ব চিত্রভাষায়৷ পঞ্চাঙ্ক রীতির নাটক যিনি লেখেন তিনিই একসময় উত্তীর্ণ হন লোকযাত্রা-অনুপ্রাণিত সেই নিজস্ব নাট্যরীতিতে যেখানে দর্শককে অনেক কিছু কল্পনা করে নিতে হয়, ওই চিত্রকরের সহযোগী মনটার মতো৷

ঠিক এইখানে এই ভাবনার একটা আশ্চর্য মিল পাই টমাস মানের লেখার৷ তাঁর ডেথ ইন ভেনিস-এর অলংকরণশিল্পী উলফগাং বর্ণকে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার কাহিনী ডেথ ইন ভেনিস অবলম্বনে তোমার গ্রাফিক ফ্যানটাসিগুলো পর্যবেক্ষণ করে অসম্ভব আনন্দ পেয়েছি৷ একজন লেখকের কাছে এটা সবসময়ই আলোড়িত ও উল্লসিত হওয়ার মতো অভিজ্ঞতা যখন দেখা যায় তাঁর মনন-জাত সৃষ্টিকে অবলম্বন করে প্রস্তুত হচ্ছে অথবা মহিমান্বিত রূপায়ণের উদ্যোগ চলছে অন্য শিল্পে যা সরাসরি আবিষ্ট করে আমাদের অনুভূতিকে—গ্রাফিক আর্ট অথবা থিয়েটার৷ এক্ষেত্রে তোমার ইলাস্ট্রেশন সত্যিই যা ঘটিয়েছে তাকে বলতে পারি স্পিরিচুয়ালাইজেশন অব দ্য সাবজেক্ট অথবা আরো সঠিক ভাবে স্পিরিচুয়্যাল এলিমেন্টস-এর উপর গুরুত্ব দেওয়া এবং তাকেই মূর্ত করে তোলা—একটা নাট্যানুষ্ঠান অথবা একটা চিত্রায়ণের কাজ সম্পর্কে যা বলে উঠতে পারাটাই সবচেয়ে খুশী হওয়ার ব্যাপার৷ আমার সবচেয়ে যা ভালো লেগেছে তা হল তোমার লিথোগ্রাফস পুরোপুরিভাবে এই নভেলের ন্যাচারালিস্টিক স্ফিয়ার থেকে সরে দাঁড়িয়েছে, এর প্যাথলজিক্যাল এবং সেন্টিমেন্টাল উপকরণকে বিশোধিত করে বেছে নিয়েছে ওনলি দ্য পোয়েটিক কোয়ালিটি!’ (অনুবাদ, পূর্ণেন্দু পত্রী)

স্পষ্টত, আধুনিক গবেষক অবনীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা-য় যে নাটকীয়তা, ভাবোচ্ছ্বাস ইত্যাদি আশা করেন তা ওই ন্যাচারালিস্টিক স্ফিয়ার-এই আটকে থাকে, ওই বিশুদ্ধ পোয়েটিক কোয়ালিটি-র কথা ভাবতেই পারে না৷ নন্দলালও প্রথম জীবনের রবীন্দ্ররচনাচিত্রণে ওইখানেই আটকে ছিলেন৷ চয়নিকা-য় তাঁর যে ছবিগুলি আছে সেগুলি তার প্রমাণ৷ ‘আমায় নিয়ে যাবি কে রে দিনশেষের শেষখেয়ায়’ ক্যাপশনে ওই বইয়ে নন্দলালের যে ছবিটি প্রকাশিত হচ্ছে সেখানে দেখি ঈষৎ ঝুঁকে ঘাটে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ, পিঠের পোঁটলার উপর থেলো হুঁকো, কোমরে ঝুলছে চাবি! কিংবা একই বইয়ে, যদি মরণ লভিতে চাও-এর সঙ্গে এক নারী অকূল নদীতে সাঁতার কাটছে!

এইখান থেকে নটরাজ ঋতুরঙ্গশালা বা সহজ পাঠ-এর নন্দলালে উত্তরণ, সে বড় সহজ কথা নয়৷ উপনিবেশের যে শিক্ষা থেকে দূরে আরও দূরে নতুন এক শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করবেন বলে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন গড়েছিলেন সেই শিক্ষাই যে চিত্রকলার শিক্ষা দেয় তা থেকে অবনীন্দ্রনাথ-নন্দলাল সরে যান, চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ বস্তুত, সেই সুরটি সহজে প্রকাশ পেয়েছিল নন্দলালের ছবিতেই৷ তাই নিজের বইয়ের অলংকরণে তাঁরই উপর রবীন্দ্রনাথ নির্ভর করেছিলেন সবচেয়ে বেশি৷

ধরা যাক ছড়ার ছবি-র পিসনিকেই৷ সেখানে পিসনি নামের লেখায় আছে, ‘অনেক গেছে ক্ষয় হয়ে তার, সবাই দিল ফাঁকি—/ অল্প কিছু রয়েছে তার বাকি৷ /  তাই দিয়ে সে তুললো বেঁধে ছোট্ট বোঝাটাকে,/  জড়িয়ে কাঁথা আঁকড়ে নিল কাঁধে৷/  বাঁ হাতে এক ঝুলি আছে, ঝুলিয়ে নিয়ে চলে…৷’ কিন্তু নন্দলাল এখানে হুবহু পিসনিকে আঁকলেন না, কাঁধের পুঁটুলি ঠিক জায়গায় রাখলেন, বাঁহাতে ঝুলিয়ে দিলেন ঘটি, ডানহাতে সুতো-বাঁধা দুখানা কুলো৷ এই শেষ দুয়ের কোনও উল্লেখ নেই ছড়ায়৷ এইখানে ছবি আর ছড়ার হুবহু চিত্রণ থাকল না, পাঠক-দর্শকের কল্পনা পেল এক নতুন উড়ানের অবসর এবং পিসনি শুধু ওই ছড়াটারই আর হয়ে থাকল না, হয়ে উঠল শাশ্বত এক চরিত্র৷

এখানে প্রশ্ন উঠবে, ছড়ার ছবি-র ছড়াগুলোই তো ছবি দেখে লেখা৷ ঠিকই, তবু একে আমরা রবীন্দ্ররচনাচিত্রণ হিসেবে ধরছি এই কারণে যে ছবিগুলো রচনার চিত্রণ হিসেবে গ্রন্থভুক্ত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের অনুমতিতেই৷ আর সেই অনুমতির মধ্যেই এ কথা স্পষ্ট যে অলংকরণে হুবহু বিষয়ের বর্ণনাই আঁকতে হবে এমনটা মনে করতেন না রবীন্দ্রনাথ৷ মনে করতেন না বলেই চয়নিকা-য় নন্দলালের ছবি পছন্দ হয়নি তাঁর৷ মনে করতেন না বলেই সহজ পাঠ-এ নন্দলালের নেওয়া স্বাধীনতাকে সানন্দ সম্মতি দিয়েছিলেন তিনি৷

তারই ফলে, চ ছ জ ঝ বোঝা নিয়ে হাটে চললেও তার ছবিতে দিগন্তের গায়ে তালগাছের সারি৷ রান্নাঘরের চালে তিনটে শালিক ঝগড়া করলেও ছবিতে দুটো৷ পূর্ণেন্দু পত্রীর কল্পনা তাই ভাবতে পারে, ‘যেন ঝগড়া করতে করতে একটা লুকিয়ে পড়েছে আড়ালে-আবডালে৷’(গ্রন্থচিত্রী নন্দলাল, দেশ বিনোদন ১৩৮৯)৷ রবীন্দ্ররচনা অলংকরণের ইতিহাসে নন্দলাল বসু তাই এক দুঃসাহসী ব্যঞ্জনার অধ্যায়৷ গ্রন্থ-চিত্রকর লিটন ল্যাম্ব যেমন সাহসকে কুর্নিশ জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ইলাস্ট্রেশন ক্যান ওনলি বি জাস্টিফায়েড ইফ দে অ্যাড টু এ বুক সামথিং দ্যাট লিটারেচার ক্যাননট এনকম্পাস৷’

আর, রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থনির্মাণেও ওই যে কিছু একটা, ‘আ লিটল এক্সট্রা’, তারই সন্ধান গ্রন্থনির্মাতার পক্ষে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ৷

ছবি: লেখকের সৌজন্যে

‘জানুয়ারি ২০১৯, বিশেষ শান্তিনিকেতন সংখ্যা’ থেকে গৃহীত।