জাপানী ভূত চতুর্দশী

আলোকময় দত্ত

Posted On: June 26, 2021

বাঙালীর যদি বারো মাসে তেরো পার্বণ হয়, জাপানীর তবে বারো মাসে আঠেরো। কথাটা মালুম হলো কিয়োতো শহরে আমাদের দশমাসের বসবাসের সময়। বসন্তের চেরীফুল ফোটা থেকে শুরু করে ডিসেম্বরের বছর শেষে ‘ব্যর্থপ্রাণের আবর্জনা’ পুড়িয়ে বহ্ন্যুতসব করে নতুন বছরকে বরণ করার ফাঁকে কত যে উৎসব, পরব আর মেলা, তার আর লেখাজোকা নেই। কিন্তু এদের মধ্যে আবার তিনটি যেন আমাদের পার্বণের আপন ভাইবোন, ‘ওবোন’ বা ‘ওবোং’, ‘হানাবি’, আর ‘গিওন মাতসুরি’— ‘ভূত চতুর্দশী’, ‘দেওয়ালি’, আর ‘রথযাত্রা’। রথযাত্রা বা দেওয়ালির কথা বরং আরেকদিন হবে, আজ প্রথমটির কথা বলি।

২০০৮ সালের কথা। আমার কাজের জায়গা ছিল কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়, ‘বাংলায় যারে কয় ইউনিভার্সিটি’। ১৫ আগস্ট বিকেলে একতলায় কফি খেতে গিয়ে দেখি আমার সহকর্মী আর ছাত্রছাত্রীরা ব্যাগ গোছাচ্ছে, নিজেদের মধ্যে কি সব গুজগুজ-ফুসফুস করছে আর মাঝেমাঝে আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। যেন আমাকে কি একটা বলি বলি করেও বলে উঠতে পারছে না, ‘কিয়োতোওয়ালি আদতে’ বাধা পাচ্ছে। আমার ওসবের বালাই নেই আর জানি এরা শেষ অবধি আর বলে উঠতেও পারবে না, তাই নিজেই শুধোলাম, “ব্যাপারটা কি? আমায় কিছু বলতে চাও?” ওরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, কিন্তু কে আগে বলবে তাই নিয়েও একটু ইতস্ততঃ ভাব। শেষে আমার পাশের টেবিলের পোস্ট-ডক্টর‍্যাল ছাত্রী শিও ইনাগাকি বলল, “দত্ত-সেন্সেই (স্যার), আপনি আজ ক’টায় বেরোতে চান?”

আমি তো তাজ্জব! কিয়োতোবাসী কোনো মহিলা বা পুরুষ আরেকজনকে কখনো এধরনের প্রশ্ন করে না, এতো ভয়ঙ্কর অনধিকারচর্চা। তার মানে নেহাতই মরিয়া অবস্থা। কিন্তু কেন? “না, মানে আজ থেকে সতেরো অবধি তো ওবোং, তাই বলছিলাম আর কি।”

‘ওবোং’, সে আবার কি ব্যাপার? আর তার সঙ্গে আমার বাড়ি যাওয়ার সম্পর্ক কি? ইনাগাকি হাজার হোক একবছর ফ্রান্সে কাটিয়েছে তাই আমার অবাক দশাটা বুঝলো। একটু খোলসা করে বলল, “ওটা আমাদের একটা ফেস্টিভ্যাল, সেন্সেই। আজ আর কাল সূর্যাস্ত থেকে ভোর হওয়া অবধি সব দরজা-জানলা বন্ধ রাখতে হবে, পরশু সন্ধের পরে আবার সবকিছু খোলা হবে। আমরা সবাই আজ একটু পরেই বেরিয়ে যাবো।”

বুঝলাম, মানে আমাকেও বেরোতে হবে। কিন্তু ব্যাপার তো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তাই ওপরতলায় আমার জাপানী দাদা, যাঁর সঙ্গে কাজ করতে এসেছি, সেই প্রফেসর ইয়োশিকাওয়ার কাছে গেলাম একটু আলোর খোঁজে।

কেনিচি ইয়োশিকাওয়া। নামের অর্থ ‘জ্ঞানেন্দ্র সৌভাগ্যনদ’। আমার ‘সৌভাগ্যদা’। যেমন শান্ত, সদাহাস্যময়, জ্ঞানী, তেমনই আবার কড়া নাস্তিক। অসময়ে আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে একটুও বিরক্ত না হয়ে একগাল হেসে বললেন, “কি ব্যাপার, আরোকাময় (জাপানীতে ‘ল’ অক্ষরটি নেই, তার বদলে ‘র’ বসানো হয়)? এনি প্রব্রেম?”

‘প্রব্রেম’ কি, বলতেই হাসি আরো চওড়া হলো, “ওহো, zat সিরি zing? একদম দরজা-জানলা বন্ধ রাখো। নাহলে দলে দলে ভূত ঢুকে পড়বে সব জায়গায়!” বলেই স্বভাবসুলভ খিকখিক করে হাসি।

লাও ঠেলা! ভূত আবার কোথা থেকে এলো? অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে একটু সদয় হয়ে দাদা বললেন, “ এই ক’দিন শহরের সবার পূর্বপুরুষরা দল বেঁধে শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ান, দরজা-জানলা খোলা পেলেই সুট করে ঢুকে পড়েন, আর বের হন না। তখন সেই বাড়ির লোকজনের হয় মহা কেলেঙ্কারি। তাই এদের এইসব কাণ্ড। আরোকাময়, জাপানীরা ভগবান মানুক বা না মানুক ভূতকে খুব মানে। ভূতের ভয়ে অস্থির সবাই!”

এবার বোঝা গেল। জাপানীতে বলা যায় “ওয়াকারিমাস”। আমাদের ভূতচতুর্দশী, সাহেবদের ‘হ্যালুইন’, আরো না জানি কোন কোন দেশে পূর্বপুরুষ বা পূর্বনারীদের ফিরে আসা আটকানোর এই ব্যবস্থা চলে। যদিও তেনারা যদি সূক্ষ্ম শরীরধারী বা ধারিণী হন তাহলে নিছক দরজা-জানলা বন্ধ রেখে কি লাভ হবে তা মাথায় ঢুকলো না। তাছাড়া জাপানীরা তো দেখি পূর্বপুরুষদেরই পুজো করে, ওদের শিন্তৌধর্ম তো আসলে তাই। বিরাট বিরাট আর স্বপ্নের মতো সুন্দর সব বাগান, তার মধ্যে রূপকথার প্রাসাদের মতো বিশাল মন্দির, যেমন তাদের আশ্চর্য স্থাপত্য তেমনই ভিতরের কারুকার্যের বাহার, কিন্তু বিগ্রহ? সেখানে বসানো হয়তো একটি পাত্র, বহুযুগ আগে মৃত কোনো সম্রাটের ‘সাকে’ মদের পাত্র বা চায়ের পাত্রখানি। তাতেই ধরা আছে সম্রাটের আত্মা, কালে যা দেবত্ব পেয়েছে। পূর্বসুরীদের আত্মা যাদের কাছে এতো প্রণম্য তারাই কিনা তাদের ভয়ে তিন দিন দরজা-জানলা বন্ধ ক’রে ঘরে আটকে পড়ে থাকে?

অবশ্যই না। যেমন আমাদের বা য়ুরোপীয়-মার্কিনদের, তেমনই নিশ্চয়ই এসব বাধা দেওয়া আর রক্ষাকবচ নেওয়ার কারণ অশুভ, অনিষ্টকারী আত্মারা যারা আত্মজনের আত্মাদের সঙ্গেই নেমে আসে শহরের অলিতে গলিতে, সুযোগ খোঁজে কখন গৃহস্থের ঘরে ঢুকে তার সর্বনাশ করতে পারে। যে অতৃপ্তি নিয়ে তাদের পৃথিবী ছাড়তে হয়েছিল, তার ভাগ যেন জীবন্ত মানুষকেও পেতে হয় সেই তক্কে তক্কে থাকে প্রেতলোকের এই বাসিন্দারা। বিশ্বের সর্বত্রই এদের নিয়ে মানুষের আতঙ্কের শেষ নেই, এদের আটকানোর জন্যই নিশ্চয় জাপানীদের এই আকুল চেষ্টা।

ব্যাপারটা নিয়ে একটু ঘেঁটে দেখার ইচ্ছে হলো। আমার সৌভাগ্যদাকে জিজ্ঞাসা করে তো কিছুই পাওয়া যাবে না, যেটুকু বললেন তার বেশি ওঁর কোনো উৎসাহ নেই তাই জানার চেষ্টাও নেই। ঘটনাকালে আমার ছেলের বয়স ছিলো বারো, আমরা সপরিবারে কিয়োতোয় ছিলাম। ও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনের কর্ত্রী শ্রীমতী আরাকি’র কাছে জাপানী শিখতো। ওঁরা কিয়োতোর খানদানী পরিবার। শ্রীযুক্ত আরাকি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক, কোয়ান্টাম ফিল্ড থিয়োরি নিয়ে গবেষণা করেন এবং পড়ান। বিরাশি বছর বয়স কিন্তু একবার আমাদের চোখের সামনে ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নেমে ক্লাস নেওয়ার জন্য দৌড় লাগিয়েছিলেন! কিয়োতো এবং জাপানের কৃষ্টির সঙ্গে পরিচয় করানোর ব্যাপারে শ্রীমতী আরাকির জুড়ি ছিল না বললেই হয়। ওঁর কাছ থেকে আমাদের পুত্র বিভিন্ন উৎসবের খবর জোগাড় করে আনত আর আমরা সেইসবে সামিল হ’তাম। উনি ছিলেন বলেই কিয়োতোর ঐশ্বর্য আমাদের চোখে-মনে-স্পর্শে এমনভাবে ধরা দিয়েছিল।

ছেলের মাধ্যমে যেটুকু জানা গেল আর বই পড়ে, আন্তর্জাল ঘেঁটে যেটুকু বুঝলাম তাতে দেখলাম যা ভেবেছিলাম কতকটা তা-ই বটে কিন্তু ব্যাপারটা আরো মজার। ‘ওবোং-মাতসুরি’ বা ‘ওবোং উৎসবের’ আদি উৎস কিন্তু খোদ মহাশ্রমণ মৌদ্গল্যায়নের এক স্বপ্নে, যেখানে তিনি দেখলেন তাঁর পরলোকগতা মা ইহলোক আর পরলোকের মধ্যে উল্লম্ব হয়ে আছেন, ক্ষুধাতৃষ্ণায় আকুল। স্বপ্নদৃষ্টা মা’র আত্মার এই ভয়ঙ্কর দুর্দশা দেখে মৌদ্গল্যায়ন যে যন্ত্রণা পেয়েছিলেন তা নিবৃত্ত করার একটাই উপায় ছিল। সেই উল্লম্ব আত্মার যথাবিহিত সেবা করে, তাঁকে মর্ত্যে ফিরিয়ে এনে কয়েকদিন পরিচর্যা, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার মধ্যে রেখে আবার সসম্মানে পরলোকে বিদায় দেওয়া। এই উপলক্ষ্যে যে উৎসবের আয়োজন করা হলো তার নাম ‘উল্লম্বন উৎসব’। এই উৎসব ক্রমে পূর্বসুরীদের আত্মাদের আবাহন, দু’দিন তাঁদের সম্মানে অনুষ্ঠান এবং তৃতীয় দিনে বিদায় জানানোয় পরিণতি লাভ করল। চীনের হাত ধরে যখন এই উৎসব জাপানে এসে পৌঁছলো তখন সেখানের উচ্চারণে ‘উল্লম্বন’ হয়ে দাঁড়ালো ‘উর-ওবোং’, কালে কালে যা ‘ওবোং’ নামেই খ্যাত হল।

জাপানী ক্যালেন্ডার আর পাঁজি আমাদের মতোই চান্দ্রমাস ধরে চলে, মানে এক পূর্ণিমা থেকে আরেক পূর্ণিমা। তাই আমাদের মতোই এদেরও পালাপার্বণ এক এক বছরে এক এক ইংরেজি ক্যালেন্ডার মাসের (অর্থাৎ সৌরমাসের) ভিন্ন ভিন্ন তারিখে পড়ে। জাপানী হিসাবে ওবোংয়ের দিন শুরু হয় ওদের ক্যালেন্ডারের নবম মাসের পনেরো তারিখে। ইংরেজি ক্যালেন্ডারে এটা অগাস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে পড়ে থাকে। সেই বছর পড়েছিল ১৫ আগস্ট থেকে। খাতায়-কলমে অফিশিয়াল ছুটি নেই কিন্তু চতুর্দিকে সব অফিস-কাছারীতে জানলা-দরজা বন্ধ করে রাখলে কাজটা আর হবে কোত্থেকে? অগত্যা এই তিন দিন ঘরেই থাকতে হবে। সৌভাগ্যদাদার অবশ্য এসবে কেয়ার-ভ্রূক্ষেপ নেই, এরমধ্যেই কাজে আসবেন। তবে উনি হলেন এখানকার পাকাপোক্ত প্রফেসর তদুপরি ডীন, ওঁর কাছে বিল্ডিংয়ে ঢোকার আলাদা চাবি, আর আমি তো ‘অতিথি অধ্যাপক’, আমার সেরকম কোনো আলাদা চাবি নেই, তাই দরজা খোলা বন্ধের জন্যে অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়। এমনিতে দরজা খোলা থাকলেও এই ক’টা দিন বন্ধই যে থাকবে তাতে সন্দেহ নেই।

যাই হোক, ঘরে বসে আমাদের বাংলাদেশি বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে দু’দিন আড্ডা মারা গেল। ওরা অনেকদিন ধরে জাপানে আছে, ভাবলাম ওবোং সম্বন্ধে আরও কিছু জ্ঞান লাভ করব। কিন্তু দুঃখের বিষয় জাপানে থাকলেও কিয়োতোয় ওরা বেশিদিন নেই আর কিয়োতো এবং আরও কয়েকটি শহরেই এইসব উৎসবের চল বেশি, অন্য শহরগুলি নেহাতই কেজো, পালা-পার্বণের ব্যাপারে কোনো উৎসাহ নেই, বরং সেখানকার লোকজন এসব দেখতে এই শহরগুলিতেই আসে।

তবে ছেলের কাছে শুনলাম ওবোংয়ের শেষদিন সন্ধ্যায় কিয়োতো ঘিরে যেসব পাহাড় রয়েছে তাদের পাঁচটাকে আলো দিয়ে সাজানো হবে। আলো দিয়ে এক একটি ‘কাঞ্জি’ অক্ষর তৈরি করা হবে, যাতে সেই আলোর পথ দেখে দেখে যেসব আত্মারা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তাঁরা বিদায় নেন। ‘কাঞ্জি’ মানে এককথায় ‘ছবি-অক্ষর’— এক একটি অক্ষর এক একটি ‘মূল শব্দ’ যেমন ‘আগুন’, ‘জল’, ‘ফুল’, ‘পুরুষ’, ‘নারী’, ‘শিশু’ ইত্যাদি। তৈরি হয়েছে এই বস্তুগুলোর ছবি সরল করে। যেমন ‘দাই’ (‘বিরাট’, ‘মহা’) শব্দটা যে কাঞ্জি দিয়ে লেখা হয় তা আসলে একটি লোকের ছবি, দু’হাত আর দু’পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই মূল শব্দ জুড়ে জুড়ে আবার নতুন শব্দ তৈরি হয়, যেমন ‘হানাবি’ বা ‘বাজি’। কথাটির আক্ষরিক মানে ‘আগুনের ফুল’। ‘হানা’ অর্থাৎ ‘ফুল’ আর ‘বি’ অর্থাৎ ‘আগুন’ এই দু’টি কাঞ্জি জুড়ে তৈরি এর কাঞ্জি।

এই আলোকপথের আয়োজন করা হয় সেইসব পাহাড়ে যেখানে কোনো মন্দির আছে। ভাগ্যক্রমে আমাদের ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে সামনেই দেখা যায় ‘ইয়োশিদা’ পাহাড়, সেখানে মন্দির আর বাগান আছে, তার উপরে সাজানো হবে ‘দাই’ কাঞ্জি, ঘরে বসেই দেখতে পাবো।

এই ইয়োশিদা পাহাড়ের মন্দির নিয়ে একটা ঘটনা মনে পড়ল। জাপানে আসার পরে এটাই প্রথম মন্দির যেখানে আমরা সপরিবারে গিয়েছিলাম। শিন্তৌ মন্দির, অন্য মন্দিরগুলোয় যেমন এখানেও তেমনই অপূর্ব শান্তি আর সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। এই মন্দির তৈরি হয়েছে ৮৫৯ সালে, সাড়ে এগারোশো বছর আগে, কিন্তু এমনকি মন্দিরের ‘তোরি’ বা কাঠের তোরণটি অবধি তার কমলা আর কালো রঙ নিয়ে ঝলমল করছে, এদের অসামান্য রক্ষণাবেক্ষণের গুণে।

মন্দির দেখলাম, বাগানের মধ্যে ঘুরে বেড়ালাম বেশ কিছুক্ষণ, তারপর মন্দির চত্বরে ঢোকার অন্য তোরণটির দিকে এগোতে লাগলাম। এটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন ক্যাম্পাসের কাছাকাছি। সেইদিকে একটি ছোট্ট কাফে, পাহাড়ের ঢালুতে বসে আছে, তার আরও নীচে তোরণের কাছে আরেকটি কাঠের বাড়ি, তার জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভিতরে কিছু লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাফে’তে বসে কফি আর স্যান্ডউইচ খেতে খেতে বুঝলাম ওখানে কিছু একটার ক্লাস হচ্ছে, ট্রেনিং ক্লাস। বেশ কয়েকটি ‘ইয়ুকাতা’ (ছোটো কিমোনো) পরা যুবক এবং একজন অতি প্রবীণ মাস্টারমশাই। কিন্তু কিসের ক্লাস? হঠাৎ বুঝলাম ‘কেন্দো’ বা জাপানী তরোয়াল খেলা শেখার ক্লাস এটা।

এই কেন্দো’র তরোয়াল হলো বিশাল লম্বা সামুরাই যোদ্ধাদের তরোয়াল, যারা ‘স্টার ওয়ার্স’ তারা এর সঙ্গে পরিচিত থাকতে পারে। যেমন লম্বা তার ফলা তেমনই বিরাট লম্বা হাতল। দেখে বুঝলাম এখন শুধু তরোয়াল টেনে বের করে এনে বাগিয়ে ধরা শেখানো হচ্ছে। এক একজন ছাত্র গুরুর সামনে এসে তাদের শেখানো পাঠের নমুনা দেখাচ্ছে আর গুরুমহাশয় একমুখ হাসি নিয়ে প্রত্যেক ছাত্রের নমস্কারের উত্তরে গোড়ায় একবার আর শেষে একবার মাথা ঝুঁকিয়ে নমস্কার করছেন। এটাই জাপানী আদত, ছাত্রছাত্রীরা যেমন গুরুদের নমস্কার করে তাঁরাও তেমনই তাদের প্রতিনমস্কার করেন।

ছাত্রদের পালা শেষ হলে আবার একবার সবাইকে নমস্কার করে গুরু এবার তাঁর নিজের নমুনা দেখালেন। ওই বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বৃদ্ধ, দেখেই বোঝা যায় আশির কোটায় তাঁর বয়স, অবলীলায়, যেন এক নাচের মুদ্রার মতো, এক টানে ওই বিশাল তরোয়াল খাপ থেকে বের করে আক্রমণের ভঙ্গীতে দাঁড়ালেন। দেখে হাততালি দিয়ে উঠতে ইচ্ছে হলো, মনে হলো যেন সাক্ষাৎ দ্রোণাচার্য এসে দাঁড়িয়েছেন! জাপানীদের অনেক কিছু নিয়ে আমার আপত্তি আছে কিন্তু বয়সের বাধা তুচ্ছ করার এই যে মানসিক দৃঢ়তা ওদের রক্তের মধ্যে মিশে আছে তাকে শ্রদ্ধা না করে থাকা যায় না।

যাইহোক, ওবোংয়ের কথায় ফিরে আসি। ১৭ আগস্টের সকাল থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম ইয়োশিদা পাহাড়ের গা বেয়ে সারি সারি মানুষ ওঠানামা করছেন, দূর থেকে তাঁদের রঙীন পোশাক শুধু চোখে পড়ছে। কিয়োতোর আকাশে প্রায় সারা বছর ধরে মেঘ আর রোদের খেলা চলে, বৃষ্টি, কুয়াশা, হাল্কা রোদ, ঝকঝকে রোদ, দিনের মধ্যে কতবার যে এই চক্রের ঘুরপাক চলে তার অন্ত নেই। কিয়োতোর মানুষের জন্য ছাতা তাই প্রায় সারা বছরের নিত্যসঙ্গী। এখানেও এক একবার মেঘ এসে সব ঢেকে দিচ্ছে আবার কিছুক্ষণ বাদে রোদ উঠলে দেখছি মানুষগুলির ছাতা থেকে রঙ মাঝেমাঝে ঝলক দিচ্ছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ওঁদের চলাফেরার মধ্যে একটা প্যাটার্ন আছে— ওঁরা আলো দিয়ে পাহাড় সাজাতে ব্যস্ত। সেই ‘দাই’, ‘বিরাট’ বা ‘মহান’ শব্দটির কাঞ্জি। উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষায় রইলাম কখন ওঁদের কাজ শেষ হয়, কখন দিনের আলোর শেষে সন্ধ্যায় ওই কাঞ্জিটি ফুটে ওঠে।

সূর্যাস্তের অনেক আগে ওঁদের কাজ শেষ হয়ে গেল কিন্তু ওঁরা রয়ে গেলেন আলো জ্বালার জন্য। তারপর আস্তে আস্তে পাহাড়ে যখন আঁধার নেমে এলো তখন একে একে আলোর আখরে দেখা দিল সেই কাঞ্জি। চারিদিক অন্ধকার, শুধু জেগে রয়েছে ‘মহান’ শব্দটি, পৃথিবীতে ফিরে আসা আত্মাদের পথ দেখিয়ে বিদায় দেওয়ার জন্য। এদের রীতিনীতি, কুসংস্কার নিয়ে যেসব হাসিঠাট্টা করছিলাম সেসব ছাপিয়ে এই দৃশ্যের সৌন্দর্যটাই চোখের সামনে এসে দাঁড়াল, মনে করিয়ে দিল আমাদের ভূত চতুর্দশীর রাতের সারি সারি প্রদীপের আলোয় সাজানো বাড়ির বারান্দা, ছাদ আর দরজা-জানলাগুলির কথা। দুই প্রাচীন সংস্কৃতি মিলেমিশে গেল এক মুহুর্তে। পথে বার হলাম। রাস্তায় রাস্তায় মানুষজন গাড়ি থামিয়ে, বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে পাহাড়ের দিকে চেয়ে আছে। ইয়োশিদা পাহাড় ছাড়িয়ে উত্তরে ‘হিয়েই’ পাহাড়ের দিকে হাঁটতে লাগলাম। এখানে রয়েছে কাঞ্জি ‘জিশৌ’— ‘নৌকা’ বা ‘যাত্রা’। নৌকার ছবির উপর ভিত্তি করে তৈরি এই কাঞ্জি। এই পাহাড়েও আছে অনেক প্রাচীন মন্দির, তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হলো বৌদ্ধমঠ ‘এনরিয়াকুজি’, ৭৮৮ সালে যার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।  আর ওই দূরে দেখা যায় ‘আরাশিয়ামা’ পাহাড়, তার উপরে কোনো কাঞ্জি নয়, সরাসরি এক ‘তোরি’র ছবি আঁকা। ওখানে আছে বৌদ্ধমঠ ‘তেনরিউ-জি’ আর এই অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো শিন্তৌ মন্দির, ৭০০ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘মাতসুনোও-তাইশা’। আমাদের হাঁটাপথের মধ্যে এই তিনটি আলোকসজ্জা দেখা সম্ভব, তাই যতক্ষণ পারলাম দাঁড়িয়ে দেখলাম সেই শোভা। আমাদের চারপাশে আনন্দের ঢেউ, অনেকে দাঁড়িয়ে নমস্কার করছে, কেউ কেউ অস্ফুটে কোনো কিছু আবৃত্তি করছে, অনেকেরই মুখে হাসি, কিন্তু কয়েকজনের, বিশেষত প্রাচীনদের, চোখে জলের আভা যারা চলে গেছে তাদের কথা মনে করে। ফিরে এলাম। কাল থেকে আবার স্বাভাবিক কাজের দিন শুরু হবে।

ফোটো- ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত

Tagged with: , , ,