প্রফেসর শঙ্কু ও তাঁর মহাজাগতিক বৈঠকখানা

দেবরাজ গোস্বামী

Posted On: June 5, 2021

ফেলুদার গল্প হোক অথবা শঙ্কুর অ্যাডভেঞ্চার, তারিণীখুড়োর গল্পের আসর কিংবা বঙ্কুবাবুদের আড্ডা, ‘বৈঠকখানা’ বিষয়টা সত্যজিৎ রায়ের লেখায় সব সময়েই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে সত্যজিৎ কিন্তু খুব সচেতন ভাবেই ‘ড্রইং রুম’ এর ধারণাকে পরিহার করে  ‘বৈঠকখানা’ শব্দটাকেই ব্যবহার করেছেন। এই বৈঠকখানা হচ্ছে এমন একটা ঘর, যেখানে বসলেই বৈঠকি মেজাজের আমেজ পাওয়া যায়। অর্থাৎ কেবলমাত্র কেজো কথা নয়, তার বাইরেও অন্য নানা তথাকথিত অকাজের কথার মধ্যে দিয়েও মনের জানলা খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সিধুজ্যাঠা এবং তাঁর স্রস্টা সত্যজিতের ক্ষেত্রে আবার কাজের ঘর আর বৈঠকখানা একাকার হয়ে গেছে। দেশবিদেশের তাবড় মানুষেরা এসে আড্ডা দিয়েছেন সত্যজিতের সেই বিখ্যাত স্টাডি কাম বৈঠকখানায় ।

রজনী সেন রোডে ফেলুদার বাড়ির বৈঠকখানাই ছিল তার মক্কেলদের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার চেম্বার কাম গল্পের ছলে তোপসের মনের জানলা খুলে দেওয়ার ক্লাসরুম। এই ঘরে যেমন হলুদ হিস্প্যানো স্যুইজা হাঁকিয়ে এসেছেন ‘শাঁসালো মক্কেল’ দীননাথ লাহিড়ী, তেমনই এসেছেন স্বঘোষিত ‘ছাপোষা মানুষ’ জাতিস্মর মুকুল ধরের বাবা সুধীর ধর মশাই। আবার এই ঘরেই ফেলুদাকে ঘুষ দিতে এসে ব্যর্থ হয়েছেন নরেশ পাকড়াশী, আর গোলাপি মুক্তোর সন্ধানে হাজির হয়েছেন খোদ মগনলাল মেঘরাজ। এই ঘরেই জমে উঠেছে লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ুর সঙ্গে নানা সরস এবং জমজমাট আড্ডা, কখনো চা–ডালমুট, কখনো কল্লোল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ‘ডায়মন্ডা’ সহযোগে। ফেলুদার গল্পে ছোট ছোট কিছু বর্ণনা এবং সত্যজিতের আঁকা অসামান্য সব ইলাস্ট্রেশান থাকলেও এই বৈঠকখানার চেহারাটা ঠিক কেমন এ বিষয়ে খুব স্পষ্ট ধারণা অনেকদিন পাওয়া যায়নি। কিন্তু ১৯৭৪ সালে যখন ‘সোনার কেল্লা’ ফিল্মটা তৈরি হল তখন ছবিটা যে কেবল স্পষ্ট হল তা নয়, মনের মধ্যে একেবারে গেঁথে গেল চিরকালের মত। এখন যদি যে কোন ফেলুভক্তকে প্রশ্ন করা হয় ফেলুদার বৈঠকখানা বলতে প্রথমে কি মনে পড়ে তাহলে বেশীরভাগের উত্তর একই হবে। সেই উত্তর হচ্ছে যে ফেলুদা সোফায় বসে, তার পিছন দিকের দেওয়ালে টাঙ্গানো একটা বড় ছবি। ইন্ডিয়ান রেড, আলট্রামেরিন ব্লু, ক্রোম ইয়োলো এই তিন প্রাইমারী রঙের অসাধারণ প্রয়োগে আঁকা কৃষ্ণ–বলরামের ছবি। এই ছবি দেখে আপাত দৃষ্টিতে যামিনী রায়ের আঁকা বলে মনে হলেও, মূল ছবির সঙ্গে এর কিছু পার্থক্য আছে। যামিনী রায়ের আঁকা কৃষ্ণ-বলরামের ছবিতে চোখের মণি আঁকা হয় নি। কিন্তু ফেলুদার বৈঠকখানায় টাঙ্গানো এই ছবিতে দুজনেরই চোখের মণি আঁকা হয়েছে। কারণ এই কৃষ্ণ-বলরাম আসলে ‘ফেলু–তোপসে’ কেমিস্ট্রির রূপক, গোয়েন্দাগিরির পেশায় ‘চোখ খোলা’ না থাকলে চলে না। তাই যামিনী রায়ের আঁকা মূল ছবিটিকে নিজের মতো করে আবার এঁকেছেন শিল্পী ‘মানিকি রায়’ (এই নাম সই করেছেন ছবিতে) ওরফে সত্যজিৎ রায় স্বয়ং। কিন্তু এই প্রথম আমরা দেখতে পেলাম গল্পের নায়কের ব্যাকগ্রাউন্ডে এমন ছবির ব্যবহার যা তার চরিত্র, পেশা এবং রুচিবোধের প্রতি ইঙ্গিত করে। আবার একইভাবে কাশীতে মগনলাল মেঘরাজের গদিতে ব্যাকগ্রাউন্ডে ছিল সারি সারি ঠাকুর দেবতার রংচঙে বাঁধানো ছবি। “অতি ভক্তিটা চোরাকারবারিদের একটা লক্ষণ” সেটা এই বৈঠকখানার চেহারা দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায়।

এই একই ধারায় প্রফেসর শঙ্কুর বৈঠকখানাও হয়ে ওঠে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্পেস। এই ঘরে যেমন শঙ্কুর সঙ্গে আড্ডা দিতে আসেন প্রতিবেশী অবিনাশবাবু, তেমনই হাজির হন বিরল ক্ষমতার অধিকারী মাকড়দার শ্রীমান নকুড় চন্দ্র বিশ্বাস। এই বৈঠকখানায় বসেই নকুড়বাবু শঙ্কুকে তাঁর বিশেষ ক্ষমতার ডেমনস্ট্রেশান দেন আবার এখানেই তাঁকে ডাক্তার বলে ভুল করে সাহায্য চাইতে আসেন ‘খোকা’-র বাবা, ঝাঝা পোস্টআপিসের কেরানী দয়ারাম বোস। এই ঘরেই কখনো এসে পড়েন চীনের যাদুকর চী চিং, আবার কখনো শঙ্কুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু জেরেমি সন্ডার্স। এককথায় বলতে গেলে প্রফেসর শঙ্কুর বৈঠকখানা হয়ে ওঠে সেই ঘর যেখানে ছোট-বড়, উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ ভুলে গোটা বিশ্ব এসে উপস্থিত হয়। এই ঘরের একটিই মাত্র তুলনা মেলে, সেটি হল বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে শঙ্কুর স্রস্টা স্বয়ং সত্যজিতের স্টাডি কাম বৈঠকখানা ।

 শঙ্কুর গল্পের সঙ্গে সত্যজিৎ যে সব ছবি এঁকেছেন তার মধ্যে বৈঠকখানার ছবি পাওয়া যায় বেশ কয়েকটি। ‘প্রফেসর শঙ্কু ও গোলোক রহস্য’ গল্পে আমরা দেখতে পাই একটি ছবি যেখানে শঙ্কু বসে আছেন তাঁর বৈঠকখানায়, আর অবিনাশবাবু গামছায় মুড়ে আনা আশ্চর্য গোলোকটি নামিয়ে রাখছেন শঙ্কুর টেবিলের ওপর। আবার একেবারে শেষের দিকে লেখা ‘স্বর্ণপর্ণী’ গল্পে তরুণ শঙ্কু এবং জেরেমি সন্ডার্সকে মুখোমুখি বসে কথা বলতে দেখা যায় এই ঘরেই। কিন্তু এই দুটি ছবিতেই কেবল মূল চরিত্র এবং সামান্য আসবাবপত্রের সাজেশন ছাড়া আর কোন ডিটেল নেই। এই ডিটেলের সন্ধান আমরা প্রথমে পাই ‘নকুড়বাবু ও এল ডোরাডো গল্পে’। এই গল্পের শুরুই হয়েছে শঙ্কুর বৈঠকখানার পাতাজোড়া ইলাস্ট্রেশান দিয়ে। ডানদিকের সোফায় বশংবদ ভঙ্গিতে বসে আছেন নকুড়বাবু, মাঝখানে টেবিলের ওপর ভাসমান তাঁর কল্পনায় দেখানো পিতলের বুদ্ধমূর্তি আর বাঁদিকের চেয়ারে বসে আছেন শঙ্কু নিজে। ব্যাকগ্রাউন্ডে জানলা দরজা বাদ দিয়ে দেখা যাচ্ছে দেওয়ালের গায়ে টাঙ্গানো একটি ছবি। বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইনের ছবি। এই প্রথম শঙ্কুর বৈঠকখানা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট দৃশ্যগত ধারণা আমাদের মনে গড়ে ওঠে।

কিন্তু ফেলুদার বৈঠকখানায় ‘কৃষ্ণ–বলরাম’ ছবির যে জোরালো উপস্থিতি, সেই ব্যাপারটা শঙ্কুর বৈঠকখানায় এসে উপস্থিত হয় ‘আশ্চর্জন্তু’ গল্পে। এই গল্পের সঙ্গে আমরা দেখতে পাই সত্যজিতের আঁকা শঙ্কুর বৈঠকখানার এক রঙিন ইলাস্ট্রেশান। ছবির ফোরগ্রাউন্ডে বসে আছেন অবিনাশবাবু, আর তার হাতের ঘড়িটি পরীক্ষা করে দেখছে আশ্চর্জন্তু বা ‘ইয়ে’ (এক্সট্রাঅর্ডিনারি অ্যানিম্যাল)। কিছুটা দূরে সোফায় বসে রয়েছেন প্রফেসর শঙ্কু, আর তাঁর মাথার ঠিক পিছনেই দেওয়ালে টাঙ্গানো রয়েছে একটা বড় পেইন্টিং, যা শুধু ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডই নয়, একই সঙ্গে শঙ্কুর মনোজগতের সাংকেতিক উপস্থাপনাও বটে। অত্যন্ত সচেতন ভাবেই শঙ্কুর বৈঠকখানায় এই ছবিটি জুড়ে দিয়েছিলেন (আক্ষরিক অর্থেই) সত্যজিৎ রায়।

১৯১২ সালে আমেরিকায় জন্ম হয় বিখ্যাত বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদী চিত্রকর জ্যাকসন পোলক এর। চল্লিশের দশকে আমেরিকায় শুরু হয়ে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্প আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন এই শিল্পী। এঁর ছবি আঁকার পদ্ধতিও ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘অ্যাকশান পেইন্টিং’। এই পদ্ধতিতে ক্যানভাসকে মেঝেতে বিছিয়ে শিল্পী তরল রঙ ও তুলি নিয়ে হেঁটে বেড়াতেন তার ওপর। তুলি ক্যানভাসকে স্পর্শ করতো না, কিছুটা দূরত্ব থেকে তরল রঙের ফোঁটা ঝরে পড়তো ক্যানভাসের ওপর, আর চারদিক থেকে ঘুরে ঘুরে এইভাবেই জ্যাকসন পোলক নির্মাণ করতেন তাঁর বিমূর্ত ছবিগুলি। এই পদ্ধতিতে ছবি আঁকার কারণে কোন একটি পত্রিকা তাঁর নাম দেয় ‘জ্যাক দ্য ড্রীপার’।  শিল্পী নিজেই বলতেন যে এইসব ছবির কোন অন্তর্নিহিত অর্থ নেই, বরং ‘হয়ে ওঠা’ আছে। মহাজাগতিক ঘটনাবলীর আপাত ‘ক্যেয়োটিক’ অবস্থানের মধ্যেও যেমন কাজ করে একধরনের ব্যাখ্যাতীত নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মানুবর্তিতা, ঠিক তেমনই নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া কাজ করতো জ্যাকসন পোলকের চিত্র নির্মাণের মধ্যে। জনৈক শিল্প সমালোচকের মতে এইসব ছবির কোন শুরু বা শেষ নেই, এ হচ্ছে মনোজগতের অন্তহীন প্রক্রিয়ার ফসল, যা মানবিকের চেয়েও অনেক বেশি মহাজাগতিক এবং ব্যাখ্যাতীত। ১৯৫০ সালে নিউ ইয়র্কের স্টুডিওতে এইরকমই একটি ছবি এঁকেছিলেন জ্যাকসন পোলক। ছবির নাম ‘অটম রিদম’। আট ফুট লম্বা এবং সতেরো ফুট চওড়া এই ছবিটি ১৯৫৭ সালে আমেরিকার মেট্রোপলিট্যান মিউজিয়াম অফ আর্ট তাদের স্থায়ী সংগ্রহের জন্য কিনে নেয়। এই ছবিটির প্রতিলিপি নানা সময়ে বিদেশের অনেক বিখ্যাত পত্রিকায় ছাপা হয়েছে । তেমনই হয়ত কোন পত্রিকার পাতা থেকে সত্যজিৎ এই ছবির একটি অংশ (ছবির বাঁ দিকের নিচের কোণের একাংশ) কেটে নেন এবং উল্টো করে সেঁটে দেন ‘আশ্চর্জন্তু’ গল্পের জন্য আঁকা শঙ্কুর বৈঠকখানার ইলাস্ট্রেশানে, ঠিক শঙ্কুর মাথার পিছনে।

জ্যাকসন পোলকের ছবির মধ্যে যে মহাজাগতিক অনুসন্ধিৎসা রয়েছে, তাকেই পশ্চাৎপটে প্রয়োগ করে সত্যজিৎ এক অসাধারণ প্রক্রিয়ায় শঙ্কুর অন্তহীন অন্বেষণের রূপক নির্মাণ করেন। এক দিকে এই ছবি শঙ্কুর দীর্ঘ বৈজ্ঞানিক পরিক্রমার সাংকেতিক উপস্থাপনা, আবার একই সঙ্গে তা আশ্চর্জন্তু ‘ইয়ে’-র সংক্ষিপ্ত পরিচয়লিপিও বটে।  ব্যাখ্যার অতীত যে নিয়ন্ত্রনের কথা বলতেন শিল্পী পোলক তাঁর আঁকা ছবির মাধ্যমে তারই সমার্থক হয়ে ওঠে ‘আশ্চর্জন্তু’ গল্পের একেবারে শেষে গিয়ে ডায়রিতে লেখা প্রফেসর শঙ্কুর উপলব্ধি— “আমার বৈজ্ঞানিক মনের একটা অংশ আক্ষেপ করছে যে, তাকে ভাল করে স্টাডি করা গেল না, তার বিষয়ে অনেক কিছুই জানা গেল না। সেই সঙ্গে আর একটা অংশ বলছে যে, মানুষের সব জেনে ফেলার লোভের একটা সীমা থাকা উচিত। এমন কিছু থাকুক যা মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করতে পারে, বিস্ময় জাগিয়ে তুলতে পারে”। এইভাবেই সত্যজিৎ শঙ্কুর বৈঠকখানা ঘরের মধ্যে একটিমাত্র চিত্রকলার অবস্থান ঘটিয়ে এক অন্তহীন মহাজাগতিক বিস্তৃতিতে উত্তরন ঘটান। এই মনোজগতে শঙ্কু সম্পূর্ণ একক, সামনে বসে থাকা অবিনাশবাবু কোনোদিনই সেই জগতের নাগাল পান না।

ছবি: লেখকের সৌজন্যে

সেপ্টেম্বর ২০১৮, ৮৩-তে বুদ্ধদেব গুহ’ সংখ্যা থেকে গৃহীত।